মানুষটি বলল, এ্যাঁ?
টুম্পা বুঝতে পারল সে প্রশ্নটা করে ফেলেছে ইংরেজিতে। এই মানুষটা একেবারে সাধারণ চেহারার মানুষ, নিশ্চয়ই ইংরেজি জানে না। তাই এবার বাংলাতে জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথা থেকে এসেছেন?
মানুষটা বলল, দুবাই।
ও! এখন হঠাৎ করে টুম্পা বুঝতে পারলো এতো সকালে এয়ারপোর্টে কেন এত ভীড়। ইন্টারনেট থেকে সে জেনেছে বাংলাদেশের অনেক মানুষ মিডলইস্টে কাজ করতে যায়, সেরকম মানুষদের নিয়ে নিশ্চয়ই একটা প্লেন এসেছে। এই মানুষগুলো নিশ্চয়ই সেই প্রবাসী শ্রমিক। টুম্পা আবার কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ কোথা থেকে একটা পুলিশ এসে এই মানুষগুলোকে যাচ্ছেতাই ভাবে গালাগাল করতে লাগলো, টুম্পা এতো অবাক হলো বলার নয়, বাংলাদেশের পুলিশরা এরকম কেন? আমেরিকাতে পুলিশেরা তো খুব ভদ্র ব্যবহার করে। টুম্পা খানিকক্ষণ চেষ্টা করলো বোঝার জন্যে পুলিশটা কেন মিডল ইস্ট থেকে ফিরে আসা শ্রমিকের সাথে কেন এতো খারাপ ব্যবহার করছে। বুঝতে না পেরে পুলিশটাকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি এই প্যাসেঞ্জারের সাথে এরকম ব্যবহার করছেন কেন?
আর বলবেন না। পুলিশটা মুখ খিঁচিয়ে বলে, এই যন্ত্রনারা মিডল ইস্টে গিয়ে ঘর ঝাড়ু দেয়, আর দেশে এসে ভাব করে যেন একেকজন একটা লাট সাহেব!
টুম্পা খুব অবাক হলো তার কথা শুনে, বলল, আপনি জানেন এরা বাংলাদেশের জন্যে কতো ফরেন কারেন্সি আনেন?
পুলিশটা একটু থতমত খেয়ে হাত নেড়ে বিষয়টা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গী করল, সেটা দেখে টুম্পার মেজাজ আরো গরম হয়ে গেল। সে গলা উঁচিয়ে বলল, এরা বাংলাদেশে রেমিটেন্স পাঠান আট বিলিয়ন ডলার। আট। এক বিলিয়ন ডলার কতো টাকা জানেন? সাত হাজার কোটি টাকা। বুঝেছেন?
পুলিশটা কী বুঝেছে কে জানে, সে একবার চোখ পিট পিট করে তাকালো। টুম্পা বলল, আপনার এই সুন্দর পোশাক, এই এয়ারপোর্ট, আপনার বেতন সবকিছু এই মানুষগুলো উপার্জন করে আনে, আর আপনারা তাদের সাথে এরকম খারাপ ব্যবহার করেন? ছিঃ!
টুম্পা মনে হয় গলা একটু উঁচিয়ে কথা বলে ফেলেছিল, কারণ দেখা গেল রেগে খাপ্পী হয়ে থাকা শ্রমিকেরা অনেকেই কান পেতে টুম্পার কথাটা শুনলো তারপর সবাই একটা গর্জন করে উঠলো, কেউ একজন বলল, ধর শালা পুলিশকে! কতো বড় সাহস আমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে?
সাথে সাথে পুরো এয়ারপোর্টে একটা তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়ে গেল, টুম্পা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে, দেখে কেউ একজন খপ করে পুলিশটার কলার ধরে ফেললো এবং তাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। হৈ চৈ চেঁচামেচি গোলমাল, আরো অনেক পুলিশ কোথা থেকে হাজির হয় পুলিশের বাঁশি বাজতে থাকে, মানুষজনের চিৎকার দাপাদাপি হুটোপুটিতে পুরো এলাকাটা সরগরম হয়ে যায়।
টুম্পার সামনে একজন বিদেশিনী দাঁড়িয়ে পুরোটা অবাক হয়ে দেখছিল, সে ঘুরে টুম্পার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কী বলে এই সবমানুষগুলোকে এভাবে খেপিয়ে দিলে?
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, আমি এমন কিছু বলি নাই! মানুষগুলো মনে হয় খেপেই ছিল।
খেপে ওঠার কারণে অবশ্যি একটু লাভ হলো। আরো কয়েকটা কাউন্টার খুলে তাড়াতাড়ি সবাইকে বের করে দেয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হলো।
টুম্পা ইমিগ্রেশন থেকে বের হয়ে কনভেয়ার বেল্টের উপর থেকে খুঁজে তার স্যুটকেস দুটো বের করে একটা কার্টের উপর তুলে ঠেলে ঠেলে বের হতে থাকে। কাঁচের দেয়ালের অন্যপাশে অনেকে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের ভেতর কেউ একজন নিশ্চয়ই তার ছোট খালা, কিন্তু সে তাদের কাউকে চেনে না! প্রথমে বের হওয়া যাক, তারপর খুঁজে বের করবে।
কাস্টমসের মানুষগুলো উদাসভাবে বসে ছিল, টুম্পাকে কিন্তু জিজ্ঞেস করলো না এবং টুম্পা তার স্যুটকেস নিয়ে বের হয়ে এল। বাইরে এসে সে যখন এদিক সেদিক তাকাচ্ছে তখন হঠাৎ কোথা থেকে টকটকে ফর্সা মোটা সোটা একজন মহিলা এবং তার পিছু প্রায় টুম্পার বয়সী দুজন ছেলেমেয়ে তার দিকে ছুটে এল। মোটাসোটা মহিলাটি বললেন, টুম্পা? টুম্পা কোনো উত্তর দেবার আগেই মহিলাটি তাকে জাপটে ধরে ফেলে তার চোখেমুখে এবং ঘাড়ে চুমু খেতে শুরু করলেন। টুম্পা শুনলো চুমু খাবার ফাঁকে ফাঁকে বলছেন, ও মা! তুই কতো বড় হয়েছিস! কতো বড় আর কত সুন্দর! তোকে আর আমি যেতে দেব না। একটা সুন্দর দেখে জামাই খুঁজে বের করে তোর বিয়ে দিয়ে দেব। ঘরজামাই করে দেব–
টুম্পার বয়সী মেয়েটা বিব্রত হয়ে বলল, আম্মু, কী করছ তুমি? কী করছ?
মহিলাটি নিশ্চয়ই ছোট খালা হবেন, মেয়েটির কথাকে এতোটুকু পাত্তা দিলেন না, টুম্পাকে আরো জোরে জাপটে ধরে বললেন, তুই একেবারে এতটুকুন ছিলি। জন্মের পর আমি সবার আগে তোকে কোলে নিয়েছি, কথা নেই বার্তা নেই তুই ঝির ঝির করে পেশাব করে দিলি–
এবার মেয়েটি আসলেই খুব বিরক্ত হলো, মাকে টেনে সরানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, আম্মু তুমি এখন থামবে?
ছোট খালা আমার কোনো লক্ষণ দেখালেন না, টুম্পার চোখে মুখে মাথায় চুমু খেতে খেতে বললেন, কতোদিন তোরে দেখি না! আহারে! এই খালার কথা তোর একবারও মনে পড়ে নাই?
দুই ভাই বোন মিলে এবারে তার মা আর টুম্পাকে টেনে আলাদা করে বলল, ছেলেটা বলল, টুম্পা আপু তুমি কিছু মনে করো না! তুমি বাংলাদেশে আসছ খবর পাবার পর থেকে আম্মুর মোটামুটি মাথা খারাপ হয়ে গেছে!