নতুন বাবার সাথে টুম্পার কখনোই একটা আন্তরিক সম্পর্ক হয় নি। যখন তার মায়ের সাথে বিয়ে হয় সে ছিল অনেক ছোট, পুরো ব্যাপারটা ছিল এক ধরনের বিভীষিকার মতো। সে ধরেই নিয়েছিল যে মানুষটি আম্মুকে তার কাছ থেকে আলাদা করে ফেলেছে সেই মানুষটি ভালো মানুষ না। তার নতুন বাবা কোনোদিন সেই ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করেন নি। যত দিন গিয়েছে টুম্পা টের পেয়েছে তার নতুন বাবা আসলে তার সত্যিকার বাবা না, তার আম্মুকে বিয়ে করা একজন মানুষ! তার নতুন বাবা কোনোদিন তাকে সত্যিকার অর্থে আদর করেন নি, বড়জোর তাকে সহ্য করেছেন। বড় একজন মানুষ হয়েও ছোট একটি মেয়েকে তাচ্ছিল্য করেছেন। টুম্পার অনেক ছোটখাটো সখকে গলা টিপে মেরেছেন। বাংলাদেশে যাওয়া নিয়ে তার সখটুকুকে টুম্পা প্রথমবার মরে যেতে দেয় নি। সেটার জন্যে রীতিমতো যুদ্ধ করেছে। বাবা কথাবার্তায় অনেকবার বলেছেন বাংলাদেশটা কতো ভয়ংকর সেটা টুম্পাকে বোঝানোর জন্যে তাকে একদিন বাংলাদেশ পাঠাবেন, কিন্তু যখন টুম্পা নিজেই বাংলাদেশ যাবার জন্যে প্রস্তুত হলো বাবা পুরোপুরি বেঁকে বসলেন। ঠিক কারণটা কী বাবাও পরিষ্কার করে বলেন না টুম্পাও বুঝতে পারে না। কীভাবে কী হলো কে জানে টুম্পাও গো ধরে বসল সে বাংলাদেশে বেড়াতে যাবেই! দুজনের মাঝে রীতিমতো যুদ্ধ, অনেকটা কে হারে কে জেতে অবস্থা!
শেষ পর্যন্ত কী হতো কে জানে কিন্তু আম্মু বিষয়টাকে সামলে নিয়েছেন। দেশে ছোট বোনের সাথে কথা বলে বাংলাদেশে টুম্পার থাকার ব্যবস্থা করেছেন এবং বাবাকে অনেক কষ্টে রাজী করিয়েছেন। টুম্পা তার নিজের টাকা দিয়ে প্লেনের টিকেট কিনেছে। বাংলাদেশ কনসুলেট থেকে পাশপোর্টে ভিসার প্রয়োজন নেই সিল বসিয়েছে। দেশে তার ছোট খালা আর খালাতো ভাইবোনের জন্যে উপহার কিনেছে। ছবি তোলার জন্যে ডিজিটাল ক্যামেরা কিনেছে তারপর একদিন জে,এফ.কে এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনে চেপে বসেছে। এখন গ্রীষ্মকালীন ছুটি, টুম্পা যাচ্ছে মাত্র চার সপ্তাহের জন্যে কিন্তু তারপরেও প্লেনে ওঠার সময় আম্মুর চোখ ছল ছল করতে লাগলো।
টুম্পা প্লেনের সিটে হেলান দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো। বাংলাদেশে তার এই ভ্রমণটা আসলে শুধু ভ্ৰমণ না, এটা একদিক দিয়ে একটা চ্যালেঞ্জ অন্যদিক দিয়ে একটা তীর্থযাত্রায় যাবার মতো! সে এখান থেকে ঘুরে গিয়ে বলতে চায় যেখানে আমার জন্ম হয়েছিল আমি সেই জায়গাটা দেখে এসেছি। আমি সেই মাটিতে পা রেখেছি, সেই বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়েছি সেই পানিতে শরীর ভিজিয়েছি। কেন সে এটা করতে চায় সে জানে না। সেটা নিয়ে টুম্পা মাথাও ঘামায় না, সবকিছুরই যে একটা ব্যাখ্যা থাকবে সেটা কে বলেছে? টুম্পা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে, খুব ধীরে ধীরে বাইরে আলো হয়ে আসছে। সে সেখান থেকে আসছে সেখানে দিন শেষ হয়ে এখন অন্ধকার নেমে আসছে আর এখানে ঠিক তার উল্টো বিষয়টা চিন্তা করেই টুম্পার কেমন জানি অবাক লাগতে থাকে! জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় ছাড়াছাড়া একধরনের ঘুমে টুম্পার দুই চোখ বন্ধ হয়ে আসে।
টুম্পার যখন ঘুম ভাঙলো তখন বিশাল প্লেনটা নিচে নামার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। টুম্পা জানালা দিয়ে নিচে তাকায়, যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। বিশাল নদী তার ভেতর দিয়ে একেবেকে যাচ্ছে। প্লেনটা ধীরে ধীরে নিচে নামছে একটু পর পর কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে চারিদিক, পরের মুহূর্তে আবার সব মেঘ কেটে ঝকঝকে নীল আকাশ। টুম্পা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। এটিই সেই দেশ? যে দেশে তার জন্ম হয়েছিল?
প্লেনটা শেষ পর্যন্ত রানওয়েতে ল্যান্ড করলো তারপর ধীরে ধীরে ট্যাক্সি করে টার্মিনালের দিকে এগুতে থাকে। টুম্পা মনে মনে অনুমান করেছিল দেখবে ছোট একটা এয়ারপোর্ট, কিন্তু আসলে বেশ বড়। অনেকগুলো ছোট বড় প্লেন সারি বেধে দাঁড়িয়ে আছে।
প্লেনটা থামার সাথে সাথে যাত্রীদের সবার মাঝেই বেশ একটা হুটোপুটি লেগে গেল, সবাই নিজের ব্যাগ নামিয়ে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় আর কিছুক্ষণের মাঝেই সবাই প্লেন থেকে নামতে শুরু করে। প্লেন থেকে নামার সাথে সাথে তাকে গরমের একটা হলকা এসে আঘাত করে। এটাই তাহলে বাংলাদেশের গরম? সবাই ব্যস্ত ভঙ্গীতে হাঁটছে তাদের পিছু পিছু বেশ খানিকটা জায়গা এসে টুম্পা একটা বড় হলঘরের মতো জায়গায় হাজির হলো, সেখানে অনেক মানুষ তারা ইমিগ্রেশনের ভেতর দিয়ে যেতে চেষ্টা করছে। টুম্পা অবাক হয়ে গেল–এতো সকালে এততো মানুষ কোথা থেকে এসেছে?
টুম্পার আমেরিকান পাসপোর্ট, তাই সে বিদেশীদের জন্যে আলাদা লাইনটিতে দাঁড়িয়েছে। এই লাইনের মানুষগুলোর শুধু পাসপোর্টগুলোই বিদেশী, মানুষগুলোর বেশিরভাগই এই দেশেরই। টুম্পা ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকে এবং খুব ধীরে ধীরে লাইনটা এগুতে থাকে। তার পাশে অনেকগুলো লাইন বাংলাদেশের মানুষের জন্যে, সেগুলোতে খুব ঝামেলা হচ্ছে, লাইনগুলো মোটেই এগুচ্ছে না এবং যারা দাঁড়িয়ে আছে আস্তে আস্তে তাদের মেজাজ গরম হয়ে উঠছে। টুম্পা কারণটা কিছুক্ষণের মাঝেই বুঝে গেল, যে পুলিশগুলো এখানে দাঁড়িয়ে আছে তারাই ঝামেলা করছে। ভালো পোশাক পরা মানুষগুলোকে লাইন ভেঙে সামনে নিয়ে যাচ্ছে। মিলিটারির অনেকগুলো মানুষ এসে লাইন ভেঙে সবার আগে চলে গেল, টুম্পা বাজী ধরে বলতে পারে এই মানুষগুলোকে সারাজীবন শুধু নিয়ম মেনে চলার কথা শেখানো হয়েছে, অন্য কেউ নিয়ম ভাঙলে তারা নিশ্চয়ই রেগে আগুন হয়ে যায় অথচ এখন তারাই কী সুন্দর নিয়ম ভেঙে সবার সামনে দিয়ে দাঁড়াচ্ছে! টুম্পা পাশের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি কোথা থেকে এসেছেন?