জিম জিজ্ঞেস করল, তুমি যে বললে শেষ করো নি? কোথায়? এটা তো শেষ হয়েছে!
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, না শেষ হয় নাই।
কোন জায়গাটা শেষ হয় নাই?
টুম্পা বলল, তুমি যদি দেখে বুঝতে না পার তাহলে আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না!
জিম ঘাড় ঝাঁকিয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে অন্য ছবিগুলো দেখতে চলে গেল।
ঠিক সময়মতো অনুষ্ঠানের শেষ পর্ব শুরু হয়েছে। আয়োজকদের একজন প্রথমে সবাইকে অভ্যর্থনা জানালেন। তারপর স্থানীয় একজন মহিলা শিল্পীকে একটা পদক দেওয়া হলো। পদকটি নিয়ে সেই মহিলা শিল্পী তার দুই একটি কথা বললেন, তারপরই পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়ে গেল। এ ক্যাটাগরিতে প্রথম হলো একটি কালো ছেলে, সে যখন পুরস্কার নিতে গেল তখন তাকে দেখে কারো সন্দেহ থাকে না যে সে বড় হয়ে একজন সত্যিকারের শিল্পী হবে মাথায় এলোমেলো চুল, ঢিলেঢালা বিবর্ণ টি সার্ট, ঢুলু ঢুলু চোখ! দ্বিতীয় হলো সোনালি চুলের ফুটফুটে একটি মেয়ে। তৃতীয় হলো দুজন, একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে, পুরস্কারটা কীভাবে দুজন ভাগ করে নেবে সেটা ঠিক করতে আয়োজকদের খানিকক্ষণ মাথা ঘামাতে হলো।
বি ক্যাটাগরির পুরস্কার ঘোষণার ঠিক আগে আগে টুম্পার বুকটা ধুকপুক করতে লাগলো। সে জানে এখানে যারা আজ ছবি আঁকতে এসেছে তারা সবাই খুব সুন্দর ছবি আঁকতে পারে। কম্পিটিশন শেষ হবার পর টুম্পা ঘুরে ঘুরে ছবিগুলো দেখেছে, অনেকেই একেবারে অসাধারণ। মিসেস হেনরিকসন বলেছেন ছবি আঁকা হচ্ছে একটা সৃজনশীল কাজ, সৃজনশীল কাজে কোনো কম্পিটিশন হয় না। টুম্পা নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল, আজকেও কোনো কম্পিটিশন নেই, পুরস্কার পাওয়া বা না পাওয়াতে কিছু আসে যায় না। সবাই মিলে আনন্দ করেছে সেটাই সবচেয়ে বড় কথা। এতো সব কিছু জানার পরেও টুম্পার বুক ধুকপুক করতে লাগলো।
প্রথম পুরস্কারের নাম ঘোষণা করা হলো। একজন হিস্পানিক ছেলে, সে আনন্দে চিৎকার করতে করতে স্টেজে ছুটে যায়। মেডেলটা গলায় ঝুলিয়ে সে দুই হাজার ডলারের চেক ভরা খামটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে স্টেজে নাচতে থাকে তার আনন্দ প্রকাশের ভঙ্গীটা এতো আন্তরিক যে সবাই হাসতে হাসতে হাত তালি দিতে থাকে। এবারে দ্বিতীয় পুরস্কারের নাম ঘোষণা করা হবে। টুম্পার কাছে মনে হয় সবকিছু কেমন যেন থেমে গেছে। মানুষটি যেন খুব ধীরে ধীরে মাইক্রোফোনের সামনে এল, তার বাইরে ধীরে ধীরে হাতের কাগজটা খুলে নামটি দেখলো তারপর মাইক্রোফোনের সামনে মুখ এগিয়ে নিলো নামটি উচ্চারণ করার জন্যে। টুম্পার মনে হলো নামটি উচ্চারণ করতে গিয়ে মানুষটি যেন থেমে গিয়েছে, স্থির হয়ে গেছে অনন্তকালের মতো!
টুম্পা রায়হান! হঠাৎ করে টুম্পা তার নিজের নামটা শুনতে পায়, কয়েকমুহূর্ত লাগলো তার বুঝতে যে সত্যিই দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়ে গেছে। কোনোমতে সে উঠে দাঁড়ালো, তার চারপাশে যারা বসে আছে তারা লাফিয়ে চিৎকার করে কনভেনশন হলের ছাদ পর্যন্ত কাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
টুম্পা হেঁটে হেঁটে স্টেজে গেল, বয়স্ক একজন মানুষ তার গলায় মেডেল পরিয়ে দিলেন, দেড় হাজার ডলারের একটা চেক ধরিয়ে দিলেন আরেকজন। টুম্পা স্টেজ থেকে নিচে নেমে আসছিল, তখন কাগজপত্র হাতে একজন টুম্পার দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হাসলো, বলল, অসাধারণ ছবি! শেষ করার সময় পেলে না, আফসোস!
টুম্পা কী বলবে বুঝতে না পেরে একটু হাসার চেষ্টা করলো। মানুষটি আবার বলল, ছবি আঁকা ছেড়ে দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার হয়ে যেয়ো না যেন!
টুম্পা বলল, হব না!
মানুষটি হঠাৎ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ছবিটার নাম দিয়েছ যশোর রোড। যশোর রোড মানে কী?
উনিশশো একাত্তর সালে আমাদের দেশে যখন যুদ্ধ হচ্ছিল তখন যশোর রোড দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ দেশ ছেড়ে গিয়েছিল। খুব সুন্দর একটা কবিতা আছে এর উপরে। এলেন গিনসবার্গের লেখা!
তাই নাকি! এলেন গিনসবার্গ আমারও খুব প্রিয় কবি। মানুষটি কাগজগুলো নিয়ে সরে যায়, টুম্পা তখন নিচে নিমে এল।
ক্লাশের সবাই তাকে ধরে জাপটাজাপটি করছে। জিম খামটা খুলে দেড় হাজার ডলারের চেকটা বের করে এনেছে! ড্যানিয়েল জিজ্ঞেস করল, ঠোম্পা!
তুমি কী করবে দেড় হাজার ডলার দিয়ে?
বাংলাদেশে যাবার জন্য প্লেনের টিকেট কিনব। কথাটা বলার আগের মুহূর্তেও টুম্পা জানতো না সে এই কথাটা বলবে। বলে ফেলার পর সে বুঝতে পারলো, অবশ্যই সে এই কথাটিই বলবে! তা না হলে কী বলবে সে?
০৪. সবুজ দেশ
প্লেনের জানালাটা উপরে তুলে টুম্পা বাইরে তাকায়। চারিদিক অন্ধকার তার মাঝে বহুদূরে বিস্তৃত একটা পর্বতমালা সোনালি আলোতে চকচক করছে। প্লেনটা এখন নেপালের পাশ দিয়ে যাচ্ছে কাজেই এটা নিশ্চয়ই হিমালয় পর্বতমালা। এর মাঝে কোনো একটা নিশ্চয়ই এভারেস্ট, টুম্পা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্বতমালাকে সে দেখছে, নিজের চোখে না দেখলে সে কী জানতো ভোর রাতে সূর্যের প্রথম আলোতে হিমালয় পর্বতের রঙ হয় কাঁচা সোনার মতো?
টুম্পা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে সে সত্যি সত্যি বাংলাদেশে যাচ্ছে। একা। তাকে যেতে দেবেই না এবং সে যাবেই–এই নিয়ে গত কয়েকটা সপ্তাহ যে কীভাবে কেটেছে সেটা শুধু টুম্পাই বলতে পারবে। সে যখন প্রথমবার বলেছিল একদিন সে বাংলাদেশে বেড়াতে যাবে সেটা ছিল একটা কথার কথা। কথাটা সে খুব জোর দিয়ে বলে নি, বিষয়টা ছিল অনেকটা ভবিষ্যৎ কল্পনার মতো। তার নতুন বাবা যখন তার সেই কল্পনাটাকে নিয়ে টিটকারি দিতে শুরু করলেন তখন সেই কল্পনাটা আস্তে আস্তে কীভাবে জানি সত্যিকারের একটা প্রতিজ্ঞা হয়ে গেল। কীভাবে যাবে সে জানতো না, তার বাবা কোনো দিনই তার পিছনে এতোগুলো টাকা খরচ করবে না কিন্তু তারপরেও টুম্পা জানতো সে একদিন বাংলাদেশে যাবেই যাবে। আটলান্টিক সিটিতে আর্ট কম্পিটিশনে দ্বিতীয় পুরস্কার হিসেবে দেড় হাজার ডলার পেয়ে যাবার পর হঠাৎ করে টুম্পা আবিষ্কার করলো তার বহুদূরের একটা কল্পনা সত্যি হয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আর পুরো ঝামেলাটাই শুরু হয়েছে তখন।