জেসিকা বলল, টুম্পা যখন ছবি আঁকবে আমরা তখন চারপাশে ঘিরে লাফাব আর চিৎকার করব, সাবাশ টুম্পা সাবাশ!
জেসিকার কথা শুনে সবাই হি হি করে হাসতে থাকে।
.
আটলান্টিক সিটিতে পৌঁছাতে তিন ঘণ্টার মতো সময় লেগে গেল। মাঝখানে কিছু একটা খাওয়ার জন্যে খানিকক্ষণের জন্যে থামা হয়েছিল কিন্তু এতোগুলো টিনএজারকে নামানোর পর আবার সবাইকে একত্র করে ভ্যানে তুলতে অনেকক্ষণ সময় লেগে গেল, তা না হলে আরো কিছুক্ষণ আগে পৌঁছানো যেতো। আটলান্টিক সিটিতে যাবার সময় টুম্পা অবাক হয়ে আবিষ্কার করলো এই বয়সের ছেলেমেয়েরা যখন একসাথে থাকে তখন কোনো কারণ ছাড়াই তাদের লাগাম ছাড়া আনন্দ হতে থাকে। তারা যেটাই করে সেটাকেই মনে হয় মজার, সেটা নিয়েই তারা হাসাহাসি করে গড়াগড়ি খেতে থাকে। প্রথম প্রথম টুম্পার একটু জড়তা হচ্ছিল কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই সে তাদের সবার একজন হয়ে গেল।
আটলান্টিক সিটি পৌঁছে কনভেনশন সেন্টারটা খুঁজে বের করে ভ্যানটাকে পার্ক করে সবাই ছুটতে ছুটতে যখন কনভেনশন সেন্টারের গেটে এসে পৌচেছে তখন কম্পিটিশন প্রায় শুরু হয়ে গেছে। গেটে সবাই আবিষ্কার করল টুম্পা ছাড়া আর কেউ ভেতরে ঢুকতে পারবে না। ছবি আঁকার জন্যে সময় দেয়া হবে তিনঘণ্টা, তারপর সবাই ভেতরে ঢুকতে পারে। ছবিগুলো তখন টানিয়ে দেওয়া হবে বিচারকেরা ঘণ্টা দুয়েক সময় নেবেন, তারপর ফলাফল ঘোষণা করা হবে।
ভেতরে টুম্পা ছাড়া আর কেউ ঢুকতে পারবে না শুনে প্রথমে সবাই একটু চেঁচামেচি করল, মিসেস হেনরিকসন তখন তাদের শান্ত করলেন, কাছেই আটলান্টিক মহাসমুদ্র, তার বেলাভূমিতে গিয়ে সবাই সময় কাটাতে পারবে। বয়স কম বলে কেউ ক্যাসিনোতে ঢুকতে পারবে না, কিন্তু ক্যাসিনোর পাশেই আছে বিশাল বোর্ড ওয়াক সেখানে সবার জন্যে হাজারো রকমের স্ফূর্তির ব্যবস্থা আছে। তখন সবাই টুম্পাকে বিদায় জানিয়ে ছবি আঁকার জন্যে ভেতরে পাঠিয়ে দিল।
টুম্পা তার রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিয়ে খুঁজে খুঁজে তার জায়গাটা বের করলো, সবাই এর মাঝে চলে এসেছে। চারিদিকে নানাবয়সী ছেলেমেয়ে বোর্ডে কাগজ লাগিয়ে গম্ভীর মুখে বসে আছে। সামনে একটা পোডিয়াম সেখানে শুকনো চেহারার একজন বয়স্কা মহিলা মাইক্রোফোনে প্রতিযোগিতার নিয়ম কানুনগুলো বলে দিলেন। কমবয়সী একটা মেয়ে বড় পিতলের একটা ঘন্টা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেটাতে কাঠের একটা হাতুড়ি দিয়ে ঢং করে একটা ঘণ্টা বাজিয়ে দিতেই কনভেনশন সেন্টারের ছেলেমেয়েরা হাতে পেন্সিল তুলে নিয়ে স্কেচ করতে শুরু করে।
টুম্পা তার ডানে এবং বামে তাকালো, প্রায় তার বয়সী ছেলেমেয়েরা হাঁটু ছাড়িয়ে বসে কোলে বোর্ডটা নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। সামনে ছবি আঁকার সরঞ্জাম সাজানো। টুম্পা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো, মিসেস হেনরিকসন বলে দিয়েছেন তাকে এই প্রতিযোগিতায় জিততে হবে না, তাকে শুধু অংশ নিতে হবে। সে জেতার চেষ্টা করবে না, শুধু সুন্দর করে মমতা দিয়ে একটা ছবি আঁকবে। কী আঁকবে সে?
যশোর রোড! হ্যাঁ তার মাথায় এখনো মৌসুমী ভৌমিকের গাওয়া সেই গানটি গুনগুন করছে, সে সেই যশোর রোডেরই একটা ছবি আঁকবে। একটা মা তার শিশু সন্তানকে বুকে জড়িয়ে যশোর রোডে দাঁড়িয়ে আছে, শিশুটির মুখে ভয় এবং বিস্ময়, মায়ের চোখে মুখে একই সঙ্গে দুঃখ বেদনা হতাশা আর ক্রোধ। পিছনে আরো অসংখ্য মানুষ, বহু দূরে দেখা যাচ্ছে আগুনের লকলকে শিখা।
টুম্পা বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে বোর্ডের উপর ঝুঁকে পড়ে।
ঠিক কীভাবে তিন ঘণ্টা পার হয়েছে টুম্পা বলতে পারে না। যখন একজন এসে নরম গলায় বলল, মেয়ে, তোমার সময় শেষ তখন যেন সে চেতনা ফিরে পেলো! ছবিটি এখনো শেষ হয় নি–আহা, সে যদি আরো কিছুক্ষণ সময় পেতো!
টুম্পা যখন ছবি আঁকার সরঞ্জামগুলো তার ব্যাগের ভেতর ঢোকাচ্ছে তখন সে তাদের দলটিকে আবিষ্কার করলো। কয়েকজনের মাথায় বিচিত্র টুপি, মুখে রঙ মাখানো, কারো গলায় বিচিত্র মালা কিংবা হাতে কটকটে লালরঙের খেলনা। সবাই টুম্পার দিকে ছুটে এল, তাকে ঘিরে ধরে জিজ্ঞেস করল, কেমন হয়েছে? কেমন হয়েছে তোমার ছবি?
টুম্পা একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, শেষ করতে পারি নি।
জেসিকা চোখ কপালে তুলে বলল, তিন ঘণ্টাতেও শেষ করতে পার নি!
কী আঁকছিলে তুমি? পিকাসোর গুয়েনিকা?
টুম্পা হেসে ফেলল, বলল, না। গুয়েনিৰ্কা না! এমনিই একটা ছবি, আসলে সময়ের দিকে খেয়াল ছিল না।
জিম জানতে চাইলো, কেমন হয়েছে?
যেটুকু শেষ হয়েছে সেটুকু খারাপ হয় নাই।
মাইকেল জিজ্ঞেস করল, প্রাইজ পাবে?
টুম্পা মাথা নেড়ে বলল, মিসেস হেনরিকসন বলেছেন প্রাইজের জন্যে কখনো ছবি আঁকতে হয় না।
ড্যানিয়েল গলা নামিয়ে বলল, মাঝে মাঝে আঁকলে দোষ হবে না। ফাস্ট প্রাইজ দুই হাজার ডলার!
মাইকেল বলল, দু–ই–হা–জা–র! সর্বনাশ! এতো টাকা দিয়ে কী করবে? টুম্পা বলল, যে সে টাকাটা পাবে, তাকে সেটা নিয়ে চিন্তা করতে দাও। আমার এখন খুব খিদে পেয়েছে। কিছু একটা খাব চল।
তখন সবাই একসাথে হৈ হৈ করে উঠল, বলল, চল যাই। চল। আমাদেরও খুব খিদে পেয়েছে। কাছেই একটা ম্যাকডোনাল্ড আছে।
খেয়ে দেয়ে তারা যখন ফিরে এসেছে তখন সব ছবিগুলো কনভেনশন সেন্টারের দেয়ালে টানিয়ে দেয়া হয়েছে, সবাই ঘুরে ঘুরে সেই ছবিগুলো দেখছে। বিচারকদের হাতে কাগজ নাকের ডগায় চশমা, তারা খুটিয়ে খুটিয়ে ছবিগুলো দেখছেন। তারা নিশ্চয়ই ছবির মাঝে অন্য কিছু একটা খোঁজে ন কারণ খুব সুন্দর করে আঁকা একটা ছবি পাশ কাটিয়ে সাদামাটা একটা ছবির সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বিড় বিড় করে নিজেদের মাঝে কথা বলেন। সবাই মিলে টুম্পার ছবিটা খুঁজে বের করল, জেসিকা চোখ বড় বড় করে বলল, বাহ্! কী চমৎকার।