ওর আম্মা কেমন, দেখা হলে ও প্রথম কী বলবে, ও ঠিক করতে পারছিল না। যদি ওর নাম শুনে চিনতে না পারেন, তা হলে সে কী বলবে?
বাসা খুঁজে পেতে একটু দেরি হল বলে ও রিকশাওয়ালাকে একটু বেশি পয়সা দিল। বুড়ো রিকশাওয়ালা একগাল হেসে চলে যাবার পর ও একা একা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল! বাসাটি ভারি চমৎকার মস্ত বড় লোহার গেট হা করে খুলে রেখেছে, ভেতরে ফুলের বাগান, দুটি চকচকে গাড়ি। একটা বিরাট বড়, আরেকটা ছোট্ট, লাল টুকটুকে। উপরের বারান্দায় ছোট ছোট সুন্দর ছেলেমেয়ে লাফঝাঁপ করছে। কে জানে হয়তো কোনো একজন তার ভাই কিংবা বোন।
এত সুন্দর ঝকমকে বাসায় ওর নিজেকে ভারি বেমানান লাগছিল, কিন্তু বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আরও বাজে ব্যাপার। সে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই একটা কলিংবেল দেখতে পেল। একটু দ্বিধা করে ও বোতাম টিপে ধরল। ভাবছিল কড়কড় করে বুঝি বেজে উঠবে কিন্তু শুনতে পেল ভেতরে মিষ্টি বাজনার মতো একটু শব্দ হল।
একটি ছেলে দরজা খুলে দিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী খোকা, কাকে চাই?
দীপু ঢোক গিলে বলল, মিসেস রওশান বাসায় আছেন?
আছেন। ভেতরে এসো।
দীপু ছেলেটার পিছে পিছে এসে বলল, আমি তার সাথে একটু দেখা করতে চাই।
ও! ভাবী তো খুব ব্যস্ত, আজ চলে যাবেন কিনা! কী দরকার বলতে পারবে?
দীপু আস্তে আস্তে বলল, আমার ঠিক কোনো দরকার নেই, শুধু একটু দেখা। করতে এসেছি। একটু ডেকে দেবেন?
বেশ। ছেলেটা ভেতরে চলে গেল।
তার বয়েসী বেশ ক’জন ছেলেমেয়ে কার্পেটে বসে কী একটা যেন খেলছিল। বড় লোকের ছেলেমেয়েরা এগুলো দিয়ে খেলে। অনেকেই কথা বলছিল ইংরেজিতে। দীপুকে একনজর দেখে সবাই আবার খেলায় মন দিল।
দীপু কী করবে বুঝতে না পেরে একপাশে দাঁড়িয়ে চারদিকে দেখতে লাগল। কী সুন্দর করে সবকিছু সাজানো! লাল ভারী পর্দা, দেয়ালে বড় বড় চমৎকার সব ছবি, শোকেসে সুন্দর সুন্দর সব পুতুল আর হাজার হাজার বই। একপাশে ছোট খেলনার মতো একটা টেলিফোন। একটা মস্ত টেলিভিশন, তার পাশে আরও কত কী, ও সবকিছুর নামও জানে না।
ঠিক তখনি পর্দা সরিয়ে সেই ছেলেটি আর তার পেছনে পেছনে একজন খুব সুন্দরী ভদ্রমহিলা এসে ঢুকলেন। হাতে টুকটুকে একটা লাল ফ্রক, হয়তো কিছু ঠিক করছিলেন। দীপুকে দেখে বললেন, খোকা, তুমি আমার খোঁজ করছ?
দীপু মাথা নাড়ল, বলল হ্যাঁ। তারপর ভদ্রমহিলার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি দীপু।
দীপু দেখল, মুহূর্তে ওর আম্মার সারা মুখ ফ্যাকাসে বিবর্ণ হয়ে গেল। থরথর করে কেঁপে উঠলেন, হাত থেকে লাল ফ্রকটি পড়ে গেল মেঝেতে। আস্তে আস্তে এগিয়ে এলেন দুই পা, তারপর বাচ্চা মেয়ের মতো হাঁটু ভেঙে বসে পড়েলেন। আম্মা কাঁপা-কাঁপা হাতে ওকে কাছে টেনে আনলেন, বিস্ফারিত চোখে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর কিছু বোঝার আগে ওকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে উঠলেন। দীপু কাদবে না কাঁদবে না করেও কিছুতেই চোখের পানি আটকাতে পারল না।
ওর আম্মা যখন ওকে ছাড়লেন, তখন ওর শার্টের কলার, বুক ভিজে গেছে। ওর আম্মার চোখের পানিতে। কেঁদে ফেলেছে বলে ওর একা লজ্জা লাগছিল, ঘরে তাকিয়ে দেখল বাচ্চারা কেউ নেই, সারা ঘরে শুধু সে আর তার আম্মা। কেউ কেউ উঁকি মেরে দেখছে পর্দার ফাঁক দিয়ে।
আম্মা খানিকক্ষণ ওকে তাকিয়ে দেখেন, চুলে হাত বুলিয়ে দেন, তারপর কাছে। টেনে এনে মুখে চুমু দিয়ে বাচ্চার মতো আদর করেন। তারপর আবার খানিকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন চিবুক, গাল, চোখে হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেন। তারপর আবার হু হু করে কেঁদে ওঠেন। অনেকক্ষণ পরে বললেন, বাপ আমার, এতদিন পরে আমাকে দেখতে এলে?
দীপু কী বলবে বুঝতে না পেরে মাথা নিচু করে বসে রইল। আম্মা হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বললেন, কখন এসেছ?
একটু আগে।
তোমার আব্বা কোথায়?
বাসায়।
তুমি কার সাথে এসেছ?
একা।
একা? আম্মা একটু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালেন, কিন্তু কিছু বললেন না। খানিকক্ষণ ওর চুলের ভেতর হাত বুলিয়ে আবার হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বললেন, খাওয়া হয়নি তোমার, না?
উঁহু। খেয়েছি আমি স্টেশনে।
কী খেয়েছ?
পরোটা আর মিষ্টি। বলতে গিয়ে কেন জানি ওর লজ্জা লাগল।
আম্মা বললেন, ঠিক আছে, তবু এসো হাত মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে কিছু খাবে।
দীপুর কেন জানি ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছিল না। অপরিচিত লোকজন ওর ভাল লাগে না, না। ও আস্তে আস্তে বলল, আমি হাত মুখ ধুয়ে এসেছি, আর আমার একটুও খিদে পায়নি।
আম্মা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছে, না?
দীপু মাথা নাড়ল। আম্মা বললেন, ঠিক আছে, তা হলে বসো এখানে, আমি আসছি।
আম্মা ভেতরে গেলেন, তারপর সাথে সাথেই ফিরে এলেন দুটি ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে—একজন ছেলে একজন মেয়ে। আম্মা ছেলেমেয়ে দুটিকে বললেন, রুমী, লিরা, এ হচ্ছে দীপু, তোমাদের বড় ভাই।
ছেলেটি আর মেয়েটি মেশিনের মতো বলল, হ্যালো!
দীপু কী করবে বুঝতে না পেরে একটু হাসল। আম্মা বললেন, তোমরা কথা বলো, আমি আসছি।
দীপু এদের মাঝে বড়, কাজেই ওরই কথা শুরু করা দরকার, অথচ কী বলবে বুঝতে পারছিল না। ও কিছু বলার আগেই ছেলেটা খুব গম্ভীর হয়ে সোফায় বসে জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাদের ভাই?