- বইয়ের নামঃ দলের নাম ব্ল্যাক ড্রাগন
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১-২. স্কুল ছুটি শুরু হয়েছে
দলের নাম ব্ল্যাক ড্রাগন – কিশোর উপন্যাস – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
যেদিন আমাদের স্কুল ছুটি শুরু হয়েছে সেদিন সকালবেলাতেই আমি আর টিটন আমাদের পেয়ারা গাছটাতে উঠে বসেছিলাম। আমাদের মনে হচ্ছিল স্কুল ছুটি হয়েছে বলে আমাদের ফাটাফাটি আনন্দ শুরু হয়ে যাবে আর সেটা কীভাবে শুরু হয় সেটা দেখার জন্যে এতো সকালে আমরা পেয়ারা গাছে উঠে বসে আছি।
বড় মানুষেরা এই জিনিসগুলো একেবারেই বুঝতে পারে না। আমি যখন সকালবেলা বাসা থেকে বের হচ্ছি তখন আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “রাতুল এতো সকালে কই যাচ্ছিস?”
আমি বললাম, “কোথাও না।”
“কোথাও না মানে? এই যে বের হচ্ছিস। বের হয়ে কোথায় যাবি?”
আমি বললাম, “এই তো!”
“এই তো মানে?”
“এই তো মানে পেয়ারা গাছে।”
“পেয়ারা গাছে?” মনে হল শুনে আম্মু খুবই অবাক হলেন, কিন্তু এতো অবাক হবার কী আছে আমি বুঝতে পারলাম না। সকালবেলা মানুষ কী পেয়ারা গাছে উঠে বসতে পারে না?
পাশেই মিথিলা দাঁড়িয়ে ছিল সে তখন নাকি সুরে নালিশ করতে শুরু করল, “জান, আঁম্মু, ভাইয়া না পেয়ারা গাছের ডালে পা দিয়ে উল্টা হয়ে ঝুলে থাকে। গাছের উপরে টিটন ভাইয়ার সাথে মারামারি করে। আঁমি গেলে আঁমার মাথার উপর বিষ পিঁপড়া ছেড়ে দেয়।”
আমি বললাম, “এই মিথিলা ওল্টাপাল্টা কথা বলবি না। ভালো হবে না কিন্তু খবরদার।”
তখন মিথিলা নাকি সুরে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, “আম্মু দেখো ভাইয়া আঁমাকে গালি দিচ্ছে।”
আম্মু আমাকে কী কী যেন বললেন, সেই কথাগুলো আমার এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বের হয়ে গেল। আমি হু হা করে মাথা নাড়তে নাড়তে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। ছোট বোনদের যন্ত্রণায় পৃথিবীর কতো ভাইদের জীবন যে বরবাদ হয়ে গেছে কে জানে!
পেয়ারা গাছে বসে বসে আমি আর টিটন দুইটা কষা পেয়ারা খেয়ে ফেললাম। গাছ ভর্তি ছোট ছোট পেয়ারা, আমাদের কারণে কোনোদিন কোনো পেয়ারা বড় হতে পারে না। আরো একটা খাব কী না ভাবছিলাম তখন টিটন চিড়িক করে নড়ে উঠে বলল, “আউ!”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”
টিটন বলল, “বদমাইশ পাজী পিঁপড়ার বাচ্চা পিঁপড়া–” তারপর প্যান্টের ভিতরে যেখানে স্বাভাবিকভাবে কোনো পিঁপড়া যাবার কথা না–সেখান থেকে একটা পিঁপড়া ধরে বের করে নিয়ে আসে। মুখ খিঁচিয়ে বলে”এই পিঁপড়াটার আমি বোঝাব মজা! কত বড় সাহস–আমাকে কামড় দেয়? এটাকে আজকে আমি জন্মের মতো শিক্ষা দিব।”
একটা পিঁপড়াকে কেমন করে জন্মের মতো শিক্ষা দেওয়া হয় আমি নিজেও সেটা দেখতে চাচ্ছিলাম। টিটন দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “এর ছয়টা ঠ্যাং ছিঁড়ে আমি আলাদা করে দিব। তারপর দেখি সে কী করে। কেমন করে হটে।”
বিষ পিঁপড়ার পা ছেঁড়ার চেষ্টা করা নেহায়েতই বোকামির কাজ, কারণ তখন সেটা টিটনের বুড়ো আঙুলে আবার কামড়ে ধরল। টিটন বলল, “আউ! আউ!” এবং কিছু বোঝার আগে সেই পিঁপড়া তার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে প্রথমে গাছের ডালে তারপর পাতার আড়ালে গিয়ে অন্য পিঁপড়াদের মাঝে গা ঢাকা দিয়ে ফেলল। সেটাকে আলাদা করে আর খুঁজে পাওয়ার কোনো উপায় নেই। টিটন ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “দেখেছিস? দেখেছিস বদমাইশ পিঁপড়াটা কী করল?”
আমি বললাম, “টিটন? তোর শেষ পর্যন্ত পিঁপড়ার সাথে মারামারি করতে হবে? দুনিয়ায় তুই এর থেকে বড় কিছু খুঁজে পেলি না?”
টিটন বলল, “আমি মোটেও পিঁপড়ার সাথে মারামারি করছি না।”
“করছিস।”
“করছি না।”
“করছিস।”
তখন টিটন আমার সাথেই একটা মারামারি শুরু করে দিচ্ছিল কিন্তু ঠিক সেই সময় চঞ্চল এসে গাছের নিচে দাঁড়াল তাই শেষ পর্যন্ত মারামারিটা আর শুরু হল না। চঞ্চল আমাদের আরেকজন বন্ধু, এই পাড়াতেই থাকে। আমরা জানি যে চঞ্চলের নামটা একেবারেই ঠিক হয়নি–তার নাম হওয়া উচিত ছিল ”ধীর-স্থির”। তার মতো ধীর-স্থির মানুষ আমি জীবনেও দেখিনি, কিন্তু একজনের নাম তো আর ধীর-স্থির হতে পারে না তাই তাকে চঞ্চল এই ভুল নামটা নিয়েই থাকতে হচ্ছে।
চঞ্চল আমাদের ক্লাসের বৈজ্ঞানিক। অঙ্ক আর বিজ্ঞানে কেউ তার সমান নম্বর পায় না। আমাদের ক্লাসে অঙ্ক আর জ্যামিতি স্যার যখন ভুল-ভাল পড়াতে থাকেন তখন চঞ্চল ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে ফিসফিস করে বলে, “হে ইউক্লিড আপনি এদের ক্ষমা করে দেন! প্লীজ ক্ষমা করে দেন! প্লীজ প্লীজ ক্ষমা করে দেন।”
চঞ্চলের পকেটে সবসময় কোনো না কোনো বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি থাকে–হয় একটা চুম্বক না হলে একটা লেন্স না হলে কিছু লিটমাস পেপার তা না হলে। কয়েলের তার। আমাদের ঘরে আমরা ক্রিকেট প্লেয়ারের ছবি টানিয়ে রাখি চঞ্চল তার ঘরে শুধু বৈজ্ঞানিক আর গণিতবিদদের ছবি টাঙিয়ে রাখে। শুধু যে টাঙিয়ে রাখে তা না–এমন ভান করে যে এগুলো ছবি না, যেন সত্যি সত্যি আইনস্টাইন হয় রামানুজন তার ঘরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের অসম্মান হবে সেই জন্যে ছবিগুলোর সামনে আমাদের কোনো খারাপ কথাও বলতে দেয় না।
চঞ্চল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হয়েছে তোদের?”