আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কীভাবে করবি?”
চঞ্চল তার ব্যাগ থেকে কাগজ পেন্সিল বের করল। তারপর বলল, আমরা এই জায়গাটা ধরব সেন্টার। এখান থেকে কোন সুড়ঙ্গটা কোন দিকে কত দূর গেছে সেটা বের করতে হবে।”
আমি বললম, “সুড়ঙ্গটা সোজা নয়, আঁকাবাঁকা ঘুরে ঘুরে গেছে।”
চঞ্চল আবার তার ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে একটা কম্পাস বের করল, আমার হাতে দিয়ে বলল, “এই কম্পাসটা দিয়ে দিক ঠিক করতে হবে।”
টিটন জিজ্ঞেস করল, “কোন দিকে কত দূর গেছে মাপব কেমন করে?”
“কয় পা হাঁটছিস সেটা দিয়ে। যেমন দশ পা উত্তর দিকে তারপর তিন পা উত্তর-পশ্চিমে তারপর দুই পা পশ্চিমে–”
অনু বলল, “সুড়ঙ্গগুলো খুব জটিল, দেখিস কেউ যেন হারিয়ে যাস না।” টুনি বলল, “হ্যাঁ। কেউ একা যাবি না। দুজন দুজন করে।”
“কেউ হারিয়ে গেলে জোরে চিৎকার দিবি।”
চঞ্চল বলল, “গোলকধাঁধা থেকে বের হবার একটা নিয়ম আছে। তোরা সেটা জানিস?”
টিটন জিজ্ঞেস করল, “কী নিয়ম?”
“দেয়ালের একদিক ধরে এগিয়ে যাওয়া। তা হলে ঘুরেফিরে যেখান থেকে রওনা দিয়েছিস সেখানেই ফিরে আসবি।”
অনু অবাক হয়ে বলল, “সত্যি?”
“হ্যাঁ। আমার কথা বিশ্বাস না হলে কাগজে এঁকে দেখ।”
চঞ্চলের বৈজ্ঞানিক কথা বিশ্বাস না করার কোনো কারণ নেই, তাই আমরা আর কাগজে এঁকে সেটা প্রমাণ করার চেষ্টা করলাম না, বিশ্বাস করে নিলাম।
কিছুক্ষণের মাঝে আমরা তিনটা দলে ভাগ হয়ে তিন দিকে চলে গেলাম। চঞ্চল আর মিথিলা, অনু আর টিটন, আমি আর টুনি। কম্পাসটা চঞ্চলের কাছে, কাজেই আমরা এখন পা গুনে গুনে মোটামুটি আন্দাজ করে মেপে যাচ্ছি, পরে ঠিক করে বসিয়ে নেব। হেঁটে যেতে যেতে আমি টুনিকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুই এতো ভালো কারাটে কেমন করে শিখলি?”
“যখন ছোট ছিলাম তখন একদিন স্কুলে গেছি। ভোমা টাইপের একটা ছেলে আমাকে ধরে আচ্ছা মতোন পিটিয়ে দিল। আমি বাসায় এসে কান্নাকাটি করে বললাম আর কোনোদিন স্কুলে যাব না! আব্বু বললেন, সেটা তো হতে পারে না। স্কুলে তো যেতে হবে। আমি রাজি হই না। তখন আল্লু বললেন, ঠিক আছে তোকে কারাটে স্কুলে ভর্তি করে দিই। এক বছর পর তুই ঐ ছেলেটাকে পিটিয়ে দিতে পারবি। তখন আমি রাজি হলাম!”
“ছেলেটাকে পিটিয়েছিলি?”
“নাহ্। শুধু একদিন সিঁড়ির নিচে চেপে ধরে নাকটা কচলে দিয়েছি। আসলে যখন বুঝতে পারি যে পিটাতে পারব তখন আর পিটাতে হয় না।”
“আজকে তো পিটাতে হল।”
“হ্যাঁ। আজকে অন্য ব্যাপার। ভয়ানক বিপদের ব্যাপার ছিল। যদি কিছু একটা হয়ে যেতো, সর্বনাশ!”
“হয় নাই।”
“ভাগ্যিস হয় নাই।”
আমি আর টুনি কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝেই হিসাবে গোলমাল করে ফেলছিলাম। তাই আবার একটু আগে থেকে শুরু করতে হচ্ছিল। এভাবে মেপে মেপে এক সময় আমরা দেখি যেখান থেকে রওনা দিয়েছি ঠিক সেই সিঁড়ির গোড়াতে চলে এসেছি। একটু দূর থেকে মনে হল কবুতরের পাখা ঝাঁপটানো শুনতে পাচ্ছি। কাছে এসে দেখি গোবদা সাইজের একটা গুইসাপ কবুতরের খাঁচাটা ধরে কামড়াকামড়ি করে কবুতরটা ধরার চেষ্টা করছে। আমরা হাত দিয়ে শব্দ করতেই সেটা মুখ তুলে আমাদের দেখল তারপর থপ থপ করে সরে গেল। টুনি বলল, “এটা কী?”
“গুইসাপ। কবুতরটা ধরার চেষ্টা করছে।”
হঠাৎ করে আমি চমকে উঠে বললাম, “আরে!”
“কী হয়েছে?”
“সাংঘাতিক ব্যাপার।”
“কী হল?”
“এখানে এই গুইসাপটা এসেছে, তার মানে কী বুঝতে পেরেছিস?”
“না।”
“তার মানে হচ্ছে এই সুড়ঙ্গ থেকে নিশ্চয়ই বাইরে যাওয়ার একটা গর্ত আছে, একটা ফাঁক-ফোকর আছে। সেই গর্ত দিয়ে গুইসাপটা ভিতরে ঢুকেছে!”
টুনির চোখ চকচক করে ওঠে। সে বলল, “ঠিক বলেছিস!”
“তার মানে আমরা যদি গুইসাপটাকে ধাওয়া করি সেটা নিশ্চয়ই সেই গর্ত দিয়ে বের হয়ে যাবে।”
টুনি বলল, “কিন্তু আমরা যে গুইসাপটাকে তাড়িয়ে দিলাম! কোন দিকে গেল?”
“এই তো এই দিকে!” গুইসাপটা যেদিকে গেছে আমরা সেদিকে একটু খোঁজাখুঁজি করলাম, কিন্তু কোন দিকে গেছে খুঁজে পেলাম না। একটু আগে যদি ব্যাপারটা মনে পড়ত তা হলে আমরা মোটেও সেটাকে এভাবে তাড়িয়ে না দিয়ে সাবধানে ধাওয়া করতাম। পিছন পিছন যেতাম।
আমি আর টুনি যখন আফসোস করছি তখন চঞ্চল আর মিথিলা ফিরে এলো, তারা একটা কাগজে সুড়ঙ্গের খানিকটা ম্যাপ তৈরি করে ফেলেছে। আমাকে আর টুনিকে মাথা ঝাঁকাতে দেখে বলল, “কী হয়েছে?”
“একটা গুইসাপ!”
“গুইসাপ? এখানে?”
“হ্যাঁ।” আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, “তার মানে গুইসাপের যাওয়া-আসার একটা জায়গা আছে। সেই জায়গা দিয়ে আমরাও হয়তো যাওয়া-আসা করতে পারি।”
চঞ্চলের চোখ বড় বড় হয়ে গেল, বলল, “ঠিক বলেছিস।”
“কোন দিকে গেল গুইসাপটা?”
আমি দেখিয়ে বললাম, “এদিকে গিয়ে কোন দিকে যেন চলে গেছে। এখন আর খুঁজে পাচ্ছি না।”
মিথিলা বলল, “আবার হয়তো আসবে।”
চঞ্চল বলল, “গুইসাপ হচ্ছে সরীসৃপ জাতীয়। ওদের বুদ্ধিশুদ্ধি কম। মনে রেখে আবার এখানে আসার বুদ্ধিই হয়তো নাই।”
টুনি বলল, কবুতরটা ধরতে এসেছিল, খাঁচা থেকে বের করে কবুতরটার পা বেঁধে রেখে দিই। হয়তো আবার আসবে।
চঞ্চল বলল, “দেখি চেষ্টা করে!”
কাজেই আমরা প্রথমে অনু আর টিটনের ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম, তারপর কবুতরটাকে বের করে তার পা চিকন দড়ি দিয়ে খাঁচার সাথে বেঁধে রাখলাম। কবুতরটা একটু হাঁটাহাঁটি করতে পারে কিন্তু সরে যেতে পারে না। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার হলে আমরা কিছু দেখতে পাব না তাই খানিকটা দূরে ছোট একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে আমরা বেশ দূরে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম।