চঞ্চল আবার এগিয়ে যায়, মানুষটার দুই চোখে তখন আতঙ্ক, সে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে পালানোর চেষ্টা করল, সিন্দুকটাতে তার পা লেগে যায় আর সে প্রচণ্ড শব্দ করে মেঝেতে আছড়ে পড়ে। টুনি চিৎকার করে বলল, “ধর! ধর এটাকে।”
আমরা সবাই তখন মানুষটাকে চেপে ধরলাম, সে যদি শুধু একটা ঝটকা দেয় তা হলে আমরা উড়ে যাব কিন্তু মানুষটা আর সাহস করল না, চঞ্চল ঠিক তার পিঠের উপর বসে বলল, “যদি আপনি একটু নড়াচড়া করেন তা হলে ইলেকট্রিক শক দিয়ে আমি আপনার বারোটা বাজিয়ে দিব। দেড় ভোল্টের ব্যাটারির জায়গায় আমি নয় ভোল্টের ব্যাটারি লাগিয়েছি, আপনার হার্টটাকে আমি থামিয়ে দিতে পারব।”
মানুষটা নড়াচড়া করল না। টুনি প্রথমে তার কোমরে গুঁজে রাখা রিভলবারটা বের করে নিল। আমি ছুটে গিয়ে ব্যাগ থেকে নাইলনের দড়ি বের করলাম তারপর দুই হাত পেছনে এনে শক্ত করে বাঁধলাম। টুনি দেখল ঠিক করে বাঁধা হয়েছে কি না, তারপর বাড়তি দড়ি দিয়ে আমরা পা দুটি বেঁধে ফেললাম।
চঞ্চল বলল, “আমি যে জিনিসটা দিয়েছি সেইটার নাম ইনডাকশন কয়েল। আমার নিজের হাতে তৈরি করা। এর মাঝে আছে প্রাইমারি কয়েল আর সেকেন্ডারি কয়েল। প্রাইমারি কয়েলের জন্যে ব্যবহার করেছি সতেরো গেজের তার। দুই লেয়ার। সেকেন্ডারি কয়েল চল্লিশ গেজ। বিশ লেয়ার। শক দেওয়ার জন্যে কানেকশন দিতে হয়। সেই জন্যে আছে ভাইব্রেটর। শব্দ শুনছেন?
ইলেকট্রিক শক খেয়ে এই মানুষটা যতটুকু কাবু হয়েছিল চঞ্চলের বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা শুনে তার থেকে বেশি কাবু হয়ে যন্ত্রণায় শব্দ করতে লাগল।
আমি বললাম, “ছেড়ে দে। অনেক হয়েছে।”
চঞ্চল বলল, “বিগ ব্যাং নিয়ে একটু বলি।”
“থাক। আর কষ্ট দিস না।”
চঞ্চল তখন পাহাড়ের মতো মানুষটাকে ছেড়ে দিল।
টুনি বলল, “এবারে চোখ দুটি বেঁধে ফেল।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?”
“এই মানুষটাকে বিশ্বাস নাই, চোখ বাঁধা থাকলে নড়াচড়া করার সাহস পাবে না।”
আমরা তখন তার চোখও বেঁধে ফেললাম।
ঘরের আর এক কোনায় মানিক উপুড় হয়ে পড়েছিল, আর নাক থেকে রক্ত বের হচ্ছে, কেমন যেন ঘিনঘিনে চেহারা, দেখে ঘেন্না লাগে। টুনি বলল, “এটাকে নিয়ে কোনো ভয় নাই, কিন্তু এটাকেও বেঁধে ফেলি।”
আমি বললাম, “ঠিক আছে।” তারপর তাকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেললাম। আমাদের কাজ আপাতত শেষ।
আমরা ঘরটার দিকে তাকালাম, “সিন্দুকের উপর বাচ্চা মেয়েটার কঙ্কাল নিঃশব্দে শুয়ে আছে। দেখে মনে হল মেয়েটি বুঝি পুরো দৃশ্যটি নিঃশব্দে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।
আমি বললাম, “আয় সবাই যাই।”
পাহাড়ের মতো মানুষটা বলল, “কোথায় যাচ্ছ? কোথায় যাচ্ছ তোমরা?”
আমি বললাম, “তোমার কী মনে হয়?”
“প্লীজ পুলিশকে খবর দিও না। প্লীজ! প্লীজ!”
“সেটা দেখা যাবে। আপাতত তোমরা শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম নাও।”
সিন্দুকের উপর তালার চাবিটা রাখা ছিল আমরা সেটা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে দরজা বন্ধ করে বিশাল তালাটা ঘটাং করে লাগিয়ে দিলাম।
আমরা তখন প্রথমবার একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। আমি মিথিলার দিকে তাকিয়ে বললাম, “মিথিলা থ্যাংকু। তুই যদি লাফ দিয়ে মানিকের হাতটা না ধরতি তা হলে মনে হয় আমাকে গুলি করে মেরেই ফেলত!”
মিথিলা বলল, “কতো বড় সাহস! টুনি আপু উচিত শিক্ষা দিয়েছে। তাই না টুনি আপু?”
আমরা সবাই মাথা নাড়লাম, আমি বললাম, “অসাধারণ ফাইট!”
চঞ্চল বলল, “তুই তো কখনো বলিসনি তুই ফোর্থ ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্ট! কী সাংঘাতিক!”
“তোরা কি আমাকে বলার চান্স দিয়েছিস? সবসময় আমাকে সরিয়ে রেখেছিস। তোদের ধারণা শুধু তোরাই সবকিছু পারিস আমরা কিছু পারি না।”
অনু বলল, “আর সরিয়ে রাখব না। এখন থেকে আমরা সবাই ব্ল্যাক ড্রাগন।”
আমরা মাথা নাড়ালাম, বললাম, “হ্যাঁ। ব্ল্যাক ড্রাগন।”
মিথিলা বলল, “কিংবা কালা গুইসাপ।”
আমরা সবাই হি হি করে হাসলাম, কালা গুইসাপ কথাটিকেও এখন খুব খারাপ শোনাচ্ছে না।
চঞ্চল বলল, “একদিনের জন্যে অনেক অ্যাডভেঞ্চার হয়েছে। চল যাই।”
আমি বললাম, “চল।”
আমরা সেই সুড়ঙ্গ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়িটার দিকে এগোতে থাকি। হঠাৎ করে টুনি থেমে গিয়ে বলল, “ওটা কীসের শব্দ?”
আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম এবং শুনতে পেলাম সত্যিই দুম দুম করে একটা চাপা শব্দ হচ্ছে।
অনু বলল, “এখানে এতো ধুলা কেন?”
আমরা অবাক হয়ে দেখলাম সত্যিই সুড়ঙ্গের মাঝে ধুলা উড়ছে। হঠাৎ করে আমার একটা জিনিস মনে হল, সাথে সাথে ভয়ে আমার বুক কেঁপে উঠল, আমি বললাম, “সর্বনাশ!”
“কী হয়েছে?”
“মনে নাই তোদের বলেছিলাম মিশকাত মঞ্জিল ভেঙে ফেলবে?”
“হ্যাঁ।”
“মনে হয় ভেঙে ফেলার কাজ শুরু করেছে।”
চঞ্চল বলল, “আমাদের তাড়াতাড়ি বের হতে হবে।”
“হ্যাঁ। খুব তাড়াতাড়ি।”
আমরা ছুটতে ছুটতে সিঁড়ির কাছে এসে হতবাক হয়ে যাই। পুরো সিঁড়িটা ভাঙা ইট-সিমেন্ট-সুড়কি দিয়ে বোঝাই। উপর থেকে দালানটা ভাঙতে শুরু করেছে আর আমাদের বের হওয়ার রাস্তাটা বুজে গেছে। এখান থেকে এখন বের হওয়ার কোনো উপায় নেই।
আমরা অনেক উপরে চাপা দুম দুম শব্দ শুনতে পেলাম। অনেক মানুষ মিলে পুরো বিল্ডিংটা ভেঙে ফেলছে আর আমরা তার ভিতরে আটকা পড়ে গেছি।
মিথিলা চিৎকার করে বলল, “বন্ধ কর! বন্ধ কর!” কেউ তার কথা শুনল না, কেউ কিছু বন্ধ করল না।