হরদয়াল বললো–গত সপ্তাহে টাইমসে একটি সংবাদ পড়ছিলাম। লন্ডনে সেন্ট টমাসের হসপিটালে নার্স ট্রেনিং স্কুল খোলা হয়েছে। এবং আশা করা হচ্ছে তা গোটা পাশ্চাত্য জগতে নার্সিং-এর ব্যাপারে আমূল পরিবর্তন আনবে। স্যার সিডনি হার্বাটের সহানুভূতি আকৃষ্ট হয়েছে। এসবের মূলেও মে-ফেয়ারের এক মিস নাইটিঙ্গেল।
কীবল বিশেষ বিস্মিত হলো। সে বললো–বটে? স্যার সিডনি যখন, তখন সংবাদের এই মহিলাই মিস নাইটিঙ্গেল। কিন্তু এটা বিশেষ আশ্চর্যের ব্যাপার যে এই গ্রামে এক ব্যক্তি টাইমস কাগজ পড়ে। এবং সেন্ট টমাস হাসপাতালে নার্সিং স্কুলের খবর একেবারেই নতুন তার নিজের কাছে।
সে বললো–আশ্চর্য! এখানে টাইমস আসে? সেন্ট টমাসে নার্সিং স্কুল হচ্ছে?
হরদয়াল লজ্জায় পড়লো। সে বললো–তাকে সাবসক্রাইবার হওয়া বলে না। আর কাগজগুলো আসতেও সময় নেয়। গত সপ্তাহে পড়েছি, কিন্তু সংবাদটা বেশ পুরনো।
কিন্তু, কীবল বললো–তাহলেও সংবাদটা এদিকে নতুন। আমি জানতাম না। ছমাস পিছিয়ে হলেও আধুনিক ইংল্যান্ডের খবর আপনি রাখছেন যা আমরাও অনেকে জানি না। না, ক্যালকাটাতেও অনেকেই নয়।
হরদয়াল মৃদু হেসে বললো– না জানলে মোকাবিলা হয় না।
লাঞ্চ কিংবা সে নামেরই অন্য কিছু হোক ঘণ্টাদুয়েক শেষ হয়েছে। দিনের আলো তখনো উজ্জ্বল। জানলা ও পর্দার ফাঁকে একটা আলোর ফলক এসে পড়লো টেবিলের কাঁচের উপর।
সিগার ধরালো হরদয়াল এবং ডানকান। বাগচী তার পাইপ।
ডানকান বললো–হৃদলাল, তোমাকে আবার পুনরায় ধন্যবাদি। হঁহঁ মরেলগঞ্জের পক্ষ হইয়া ধন্যবাদ। ফাইন কুকিং, ফাইন ওয়াইন।
ডানকানের ঘাড়টা কি একটু নড়লো কথা বলতে গিয়ে। সেই চ্যাম্বার্টিনের বোতলটার দুপাশে টেবিলের উপরে তার হাত দুটো ছড়ানো। মনে হলো আঙুলগুলো যেন টেবিলের উপরে ড্রাম বাজানোর চেষ্টায় আছে। তার মুখ তো বটেই চোখ দুটোও লাল। সে বোতলটাকে তুলে আলোয় ধরলোর তলায় কিছু মদ আছে তখনো।
হরদয়াল বললো–আর একটা আনিয়ে নেবো?
ডানকান বললো–ও নো। উই মাস্ট লিভ। আমাদের যাইতে হইবে। বৈকাল হয়।
কীবল রসিকতা করে জিজ্ঞাসা করলো–আর উই স্যুয়োর।
ডানকান বললো–যদি না স্কুলমাস্টারের বউ-এর প্রেমে পড়ে থাকো। ইজিন্ট শি বিউটিফুল? হো হো করে সে হাসলো।
সে উঠে দাঁড়ালো। এবং সেজন্যই তার হিক্কা উঠলো। মনোহরের পাশে গিয়ে তার বগলের তলে হাত দিয়ে ঠেলে তোলার চেষ্টা করলো। বললো–ওয়াল মাই ডার্লিং গার্ল।
হরদয়াল অল্প, বাগচী ঠোঁট টিপে, কেট হাত দিয়ে মুখ ঢেকে, কীবল প্রকাশে হো হো করে হেসে উঠলো। হরদয়াল ভাবলো, এই খুশীর ভাবটা কি লাঞ্চকে সার্থক করলো!
ডানকান হোয়াইটের রসিকতার কারণটা কী–তা কি নারীবর্জিত কুঠিতে দীর্ঘদিন থাকার ফল? অথবা ব্যার্গান্ডি যার ভিনটেজ ১৮৩৫? সে দস্তানা আর চাবুক সংগ্রহ করলো। একটু কি অসমান পড়লো তার পা? যখন এইসব বিষয়ে ভাবা যাবে এক অপ্রত্যাশিত পরিসমাপ্তির সূচনা করলো বাগচী।
ডানকান ও কীবলের ঘোড়া। রাজবাড়ির ভৃত্যরাই ঘোড়াদুটিকে এগিয়ে আনলো। তাদের পিছনে হরদয়ালের পালকি নিয়ে বেহারারা, শেষে মনোহর সিং-এর এক্কা নিয়ে তার সহিস এগোলো।
বাংলোর সিঁড়ি দিয়ে নামছে মনোহর আর ডানকান তখন। বাগচী বারান্দায় কীবলের পাশে। বাগচী বললো–মিস্টার কীবল, আপনি কি আমাকে ক্ষমা করতে পেরেছেন? আমি এই পেগান রাইটের সঙ্গে স্যাক্ৰামেন্ট ইউক্যারিস্টের কথা বলে আপনার অনুভবকে আঘাত দিয়ে থাকবো। আমি দুঃখিত।
কীবল বাগচীর দিকে মুখ তুলো। কিন্তু কী বলা উচিত চট করে তা যেন খুঁজে পেলো না। এক্ষেত্রে এদেশে কিছু বলাই কি প্রথা?
শেষ সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে ডানকান পিছন ফিরলো।
সে বললো–গুডবাই হৃদলাল, গুডবাই বাগচী। আইস, কীবল। বাগচী, তোমার বোধ হয় অনুতাপে স্মরণ হয় (হিক্কা) অসাম্প্রদায়িক ক্রিশ্চিয়ানিটি আই মিন (হিক্কা) চার্চ ছাড়া যাহা তোমার তাহা মানুষকে সভ্য করে না। মানুষ হিদেনই রহে। টোমার মতো হইবে বাগডির ন্যায়।
হাসতে গেলে আবার হিক্কা উঠলো তার।
হয়তো, হয়তো–বাগচী বাও করলো। তার ঠোঁটের কোণে একটা হাসি স্পষ্ট হলো। কীবল ও কেটের মধ্যে নামতে নামতে সে বললো, ধর্মের সিম্বলগুলোর লৌকিক ব্যাখ্যা দেওয়াই বোকামি। ইউক্যারিস্টের ওয়েফার ছিঁড়ে মুখে দেওয়াকে নিশ্চয়ই কেউ নরমাংস ভক্ষণ মনে করে না, সত্যি তো সেটা ক্রাইস্টের মাংস নয়।
সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়েই ঘোড়ার লাগাম ধরলো ডানকান, ঘোড়ায় উঠতে যে জোরটা লাগে তা যেন তার মুখে প্রকাশ পেলো। হঠাৎ রেগে উঠে বললো–চও! ফের বলিলে হাড্ডি গুড়াগুড়া করিব।
কী যেন একটা ভেঙে পড়বে, যেন লাঞ্চটাই। বাগচীর মুখ এত কালো যেন তাকে চেনাই যাবে না। মনে হলো পাদরীদের পক্ষে তার কাঁধটা বিশেষ চওড়া দেখাচ্ছে। কিন্তু হো হো করে হেসে উঠলো বাগচী, বললো–লেট হিম স্লিপ ইট অফ, মিস্টার কীবল। (ঘুমিয়ে নেশাটা কাটাক)।
সিঁড়ির পাশে তখন কীবলের ঘোড়াটাও। সে কি কিছু বলবে? কিছু ভাবছে কি সে? ডানকানের ঘোড়াটা উল্টোপাল্টা নির্দেশের জন্য ল্যাজ দুলিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে একটা পাক খেয়ে সিঁড়ির দিকে ফিরে এলো। হরদয়াল হেসে বললো–গুডবাই মিস্টার হোয়াইট।
ডানকান বললো–আইম অ রাইট।