বাগচী বললো–লাখনাউতে যদি নরহত্যা হয়ে থাকে দিল্লীতেও হয়েছে। লেটস্ ড্রপ ইট।
অস্তস্তি বোধ করে গলা সাফ করলো হরদয়াল। অনেকসময়ে সুযোগ পাওয়ামাত্র তা ধরতে হয়। এই সময়ে বাবুর্চিরা ঢুকলো। ট্রের দিকে চেয়েই হরদয়াল উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো–চিকেন প্যাটিস আর দে? ওয়েল, মিস্টার হোয়াইট, আই স্পেশ্যালি ইনভাইট ইউ টু দেম। দে আর সামহোয়াট অভ এ স্পেশ্যালিটি অব মাই সোলটান আহমেদ।
হঠাৎ কী হয়ে গেলো। এই সাজানো গোছানো ঝকঝকে টেবলের পাশের মানুষগুলোকে আর যেন উৎসবের অঙ্গ বলে মনে হবে না। তাদের কথাগুলো তাদের চিন্তা যেন চীনামাটির ও কাঁচের পাত্রগুলোতে পুরনো ফাটল সৃষ্টি করছে। কেট অদ্ভুত সাহসে হোস্টেসের কাজ করলো। মধুর হেসে বললো–মিস্টারকীবল, ক্রিমিয়ায় প্রভিশন কেমন ছিলো? আপনাদের নিশ্চয়ই কষ্ট হয়েছে?
কীবলও বোধ হয় সেই মুহূর্তেই সম্বিৎ পেয়েছে। সে একটু জোর দিয়ে বললো–রাম ফর ব্রেকফাস্ট, রাম ফর ডিনার, রাম ফর ব্রোকেন লিম্বস। মিস নাইটিঙ্গেল ইজ থিংকিং অ্যাবাউট লাইস অ্যান্ড ভার্মিন অন দা সোলজার্স, ওয়েল সামাদার লেডি উইল্যাব টু থিংক আউট হোয়াট গোস অনসাইড দেম। (প্রাতরাশেরাম, ডিনারে রাম, হাত-পা গুঁড়োলে রাম। মিস নাইটিঙ্গেল সৈনিকদের গায়ের উকুন আর পোকার কথা ভাবছে। আর কাউকে ভাবতে হবে তাদের ভিতরে কী যায়)। সে হাসলো।
ডানকান তার উত্তেজনার বিষয়টা থেকে সরতে পেরেছিলো, কিন্তু ভিতরে ছিলো বিরক্তি। সে বিরক্তমুখে বললো–শি উইল আনম্যান দি সোলজার্স, দ্যাটস হোয়াট শি ইজ আফটার। (সৈনিকদের সে স্ত্রীলোক না করে ছাড়বে না। সেটাই তার উদ্দেশ্য)।
কে? কীবল জিজ্ঞাসা করলো।
ইওর লেডি উইথ দা ল্যান্টার্ন।
কীবল হো হো করে হেসে উঠলো। গশ, হোয়াইট? মিস নাইটিঙ্গেলকে লেডি উইথ দা ল্যাম্পই তো বলছে। তুমি তার হাতে লণ্ঠন দিলে?
সুতরাং প্যাটিসে কাঁটা ছোঁয়ালো তারা।
প্যাটির পর ফল-ফল আর মিষ্টি। তখন একটা যোগাযোগ ঘটে গেলো হরদয়ালের বাবুর্চির অসাবধানতায়। যেহেতু সে দেওয়ানকুঠি থেকে আনা মদের বোতলগুলোকে ভোরের অন্ধকার থাকতেই পিয়েত্রোর প্রভিশনের আলমারিতে তুলেছিলো, এবং টেবল প্রায় মদশূন্য অবস্থায় দেখে মদের আর একটা বোতল আনতে গিয়ে তাড়াতাড়িতে খেয়াল করলো না যেটা সে নিয়ে যাচ্ছে তার গায়ে অনেক মাকড়সার জাল, যা থাকা উচিত নয়। এবং বোতলটাও কালচে কাঁচের বেঁটে, মোটা এবং বেশ বড়ো। পিয়েত্রোর বাবুর্চির বান্দা লক্ষ্য করেছিলো, কিন্তু তার হাতের ইশারা হরদয়ালের বাবুর্চি সোলটান বুঝতে পারলো না।
বোতলটাকে কোমরের ঝাড়নে মুছে টেবলে রাখতে যে প্রথম অবাক হলো সে হরদয়াল। সে হাতে নিয়ে দেখলো ভিনটেজের তারিখটা ১৮৩৫। শব্দগুলো অপরিচিত।
ডানকান অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলোকী এটা? হাতে নিয়ে পড়লো, উচ্চারণ করলো চ্যাম্বার্টিন। প্রকৃত ইংরেজ কখনো ফরাসী পড়ার সুযোগ ছাড়ে না।
মদটা লাল রঙের। ইঙ্গিতে বাবুর্চি খুলে দিলো। নতুন গ্লাস দিলো সকলের সামনে।
ডানকান হয়তো আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো যে এই আসরে অন্তত একবার তা করতেই হবে কেননা সে ইংরেজ। গ্লাস হাতে নিয়ে সে বললো, আসুন আমরা স্বাস্থ্য পান করি।
সে গ্লাস হাতে উঠে দাঁড়ালো। দেখে কীবল এবং হরদয়ালও দাঁড়ালো। গ্লাসগুলো মৃদু ঝনৎকার তুলে টেবিলের উপরে শূন্যে একত্র হলো।
অট্টহাস্য করে ডানকান বললো–হিয়ার্স টু হার ম্যাজেস্টি কুইন বিক্টোরিয়া। কীবল ও হরদয়াল যুগপৎ বললো–টু হার ম্যাজিস্টি। বাগচী, কেট ও মনোহরকেও উঠতে হলো।
ফরাসী মদটা গলায় ঢেলে বসতে বসতে সশব্দে গ্লাসটা বসালো টেবলে ডানকান। সেটা তার হাতের নিচে ফাটলো কি?
সে কি ফরাসী নাম থেকে মদটা পিয়েত্রোর ভাঁড়ারের এমন আন্দাজ করেছিলো? অথবা ফরাসী শব্দগুলোই একজন পরিচিত ফরাসীর কথা মনে আনতে পারে?
হরদয়াল তার গ্লাসে আবার একটু মদ নিলো। একাই উঠে দাঁড়ালো। শূন্যে হাত তুলে বললো–দিস্ টু রানীমাতা। মে গড ব্লেস হার। পান শেষে গ্লাসটাকে সে কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে ছুঁড়ে দিলো। দেয়ালে লেগে সেটা ঝনঝন করে ভেঙে পড়লো।
ফলে হাত দিলো সবাই। সেগুলি অবশ্যই দুষ্প্রাপ্য এ অঞ্চলে এবং ইউরোপেও। হরদয়ালের ইঙ্গিতে বাবুর্চি তার চুরুটের বাক্স বার করলোকীবলের দিকে তা এগিয়ে ধরলো হরদয়াল।
কীবল এক্সকিউজ মি বলে প্রত্যাখ্যান করলো।
মনোহরই আবার সকলের চাইতে বেশি বিস্মিত হলো–সে কী, সার, সোলজার হয়েও খান না! ভালো জিনিস কিন্তু। আমাদের দেওয়ানসাহেব বিশেষ সৌখীন জানবেন।
কীবল হাসিমুখে বললো–ক্রিমিয়া-ফেরত সোলজাররা দাড়ি এবং তামাক ইংল্যান্ডে আবার ফিরিয়ে আনছে বটে। আমি কিন্তু পাইওনিয়ার্সদের একজন নই।
স্বচ্ছ কৌতুকের আশ্বাসে বাগচী বললো, ফিরিয়ে আনছে কী রকম?
মৃদু হেসে কীবল বললো–এইভাবে ফ্যাশান যাওয়া আসা করে। ইংল্যান্ডে তামাক ও দাড়ির আদল সত্তর আশি বছর ছিলো না। আবার প্রাদুর্ভাব হয়েছে। নস্য নয়, ধোঁয়া। এবং তা ক্রিমিয়ার পর।
ডানকান বললো–ইহার জন্যও কি তোমার উওম্যান উইথ ল্যাম্পকে ধন্যবাদি?
কীবল হো হো করে হেসে উঠলো। –হোয়াইট, তুমি লেডি উইথ দা ল্যাম্পকে নিয়ে মহা ফ্যাসাদে পড়েছে। কিন্তু অসুস্থ আহত ক্রিমিয়ার সেই সৈন্যদলের শয্যার পাশে তাকে কিন্তু অ্যাঞ্জেল বলেই মনে হতো। আর আমাদের মতো ভুক্তভোগী কে?