কিন্তু সুবিচার করতে হলে বলতে হবে হরদয়ালের গায়ের রং আরও কালো। সে রং আরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে এজন্য যে তার নাক নিখুঁত এবং ধারালো। চোখ দুটি টানা। চিবুক সুগঠিত। ঠোঁট দুটি বিশেষ পাতলা এবং পরস্পরসংবদ্ধ। তার মুখটা শুকনো দেখাচ্ছে। চোখের কোণে কিছু কালি। তা কি অস্বাস্থ্যের? বরং হয়তো কাল রাতের লাল মদের ফলে। তার গায়ে গরদ রং-এর গলাবন্ধ কোট।
কে বললো–আজকের আবহাওয়াটা খুব সুন্দর।
হরদয়াল বললো–তাপটা কোমল এবং আরামদায়ক।
কেটের বাঁয়ে হরদয়াল ডাইনে ডানকান। রং যদি দেখতে হয় তাকেই লক্ষ্য করতে হবে যদিও তার পদবী হোয়াইট। গাজরের মতো রং। মাথার বিরল চুল তামার ভাবযুক্ত হলুদ। কাছে থেকে দেখার ফলে বোঝা যাচ্ছে তার নাকের মাথাটা মোটা এবং লাল। মুখে যথেষ্ট গর্ত গাড়া এবং গুটি। টুইডের কোট এবং ফ্ল্যানেল ব্রিচস। ঘরে ঢুকে সে রুপোবাঁধানো মালাক্কা লাঠি জমা রেখেছে দরজার পাশে স্ট্যান্ডে। সে যে মরেলগঞ্জের ইন্ডিয়া লিমিটেডের ম্যানেজার তা তার ঘোরাফেরা ওঠাবসায় প্রমাণ, যদিও ইদানীং তার মধ্যে কিছু আড়ষ্টতা ফুটছে; সেই উনবিংশ শতকীয় বাত-যা ইংরেজ ভদ্রলোকের লক্ষণ।
ডানকান বললো–মৃদু এবং মধুর।
কেটের বিপরীতে বাগচী। বাগচী এবং হরদয়ালের মধ্যে মনোহর সিং, বাগচী এবং ডানকানের মধ্যে কীবল। মন্দির দেখতে যাওয়ার আগেই হরদয়াল কেটকে আওয়ার হোস্টেস বলে পরিচিত করে দিয়েছিলো।
মনোহর চোগা চাপকান পরেছে। মাথায় জড়ির কাজ করা শামলা। তার মুখের গড়ন রোগাটে, কিন্তু গালের মাঝামাঝি তক্ নেমে আসা চওড়া জুলফি, এবং ঠোঁটের কোণ বেয়ে ঝুলে পড়া ঝোরা ঝোরা গোঁফ সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
কীবল এখানে বয়ঃকনিষ্ঠ। যেন খড়ির তৈরি এমন সাদা। মুখের গড়নে চৌকো চোয়াল এবং প্রয়োজনের চাইতে বড়োনাক দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একেবারে কটা চোখ, চুল তামাটের চাইতে লাল। বাদামি লালে ডোরাকাটা টুইডের কোটে, গলাখোলা কামিজে দেখাচ্ছে যেন তাদের দেশের একজন আন্ডার গ্র্যাজুয়েট।
হরদয়ালের মুখোমুখি সে।
হরদয়াল বললো–মাছটা কি কিছু শক্ত ভেজেছে মনে হয়?
ডেলিশাস। কী বললো– কীবল।
কারো কারো চরিত্র তার প্রথম কথাতেই প্রকাশ পায়। মনোহর সিং বললো–কিন্তু তা বলে কি সার, এ কি আর টেমসের হেরিং।
কীবল বললো–ইউ নো টেমস?
সে কিছুটা অবাক। মনোহর কৃতার্থ।
বাট, বললো– হেসে কীবল–টেমস্ ওঅজ নেবার ফেমাস্ ফর ফিশ। ইজ ইট হিলসা দো?
বলা বাহুল্য তাদের ইংরেজি আলাপে ভাঙাচোরা বাংলা ও রংছুট বাঙালি ইংরাজির। মিশেল থাকছিলো।
হো হো করে হেসে উঠে ডানকান বললো–অ্যাংলো ক্যালকাটানদের রোগ টোমাকে ঢরেছে আমি ডেকছি। কিন্তু হিলসা টোমার টামির পক্ষে ভালো যথেষ্ট নয়। ডিসেন্ট্রি ঘটায়। হোঅট ফিশ দিস হৃদলাল?
হরদয়াল–উচিত ছিলো রুই, দেখছি কাতল।
মিষ্টি হেসে কেট বললো–আমি যে তার ব্যাপারে বিশেষ নস্ট্যালজিক তা নয়। বাট টেমস্ হ্যাজ হার ফিশে দো হেরিং ইজন্ট এ গুড ফ্রাই।
মাছের গ্রাসটাকে চিবিয়ে নিয়ে কীবল বললো– হাসিমুখে–হয়তো, হয়তো। হোয়েন ইউ লাস্ট স্ব হার। দা ব্ল্যাক ব্রাকিশ ওঅটর দ্যাটস্ নাউ টেমস্ ইজ এ ডেড রিভার ফর অল পারপাসেস। (এখন যে কালো বিস্বাদ জলকে টেমস বলা হয় তা সব রকমেই এক মৃত নদী)।
ডানকান যে বোতলটাকে খুলিয়েছিলো কীবল সেটাকে পছন্দ না করে ক্লারাট লেখা বোতলটাকে ইঙ্গিত করতে সেটা খুলে দিলো এক খানাবরদার। কীবল নিজের হাতে গ্লাস ভরে নিলো।
বাগচী আলাপে যোগ দিতে বললো–এরকম হলো কেন?
কীবল-এর বক্তব্যর অনুবাদ এই রকম–সবই কালো হতে চলেছে এখন, নদীর জল একসেপসন নয়। তাতে দুঃখও নেই। কারণ এ যুগটা কয়লা এবং লোহার–বোথ ব্ল্যাক। নয় কি? অন্য রং যদি কোথাও থাকে তবে তা হোয়াইটের নীলে।
সে হাসলো। ডানকান এই মৃদু রসিকতায় বললো—হ।
আলাপটা দ্বিতীয় কোর্সে লোহাকয়লা কারখানার দিকে গড়িয়ে তা থেকে স্টিম এঞ্জিন অবশেষে স্টিমারের গল্পে পৌঁছালো। স্টিমার যা নাকি বাষ্পের সাহায্যে সমুদ্রে চলে। কিমাশ্চর্যম্ অতঃপরং।
ডানকান বললো–কাম কাম, ফলমাউথের খেলনাগুলো ভালো কিংবা কলকেতা বন্দরে কিন্তু আমাদের বয়সে
কীবল বললো, মিট মিট করে হেসে, সে নিজের চোখে প্লীমাথেও স্টিমার দেখেছে এবং তা ম্যান অব ওআরদের মধ্যে ঘুরতে। এই শীতে ব্রিন্ডিসি পর্যন্ত আসবে স্টিমার যদি না আলেকজান্দ্রিয়া পর্যন্ত পারে।
হোয়াট ডু ই’মিন ব্রিন্ডিসি, ডানকান বললো–তুমি ডেখো, এই সমুদায় টয়েস্ সাহায্যে বড়োজোর ব্রিন্ডিসি আসা যাইবে কারণ তা ভূমধ্যসাগর।
কীবল হেসে বললো–ভূমধ্য হলেও তা সাগর।
ডানকান বললো–আটলান্টিক, প্যাসিফিক অথবা ভারতসাগরে স্টিমার আসিবে? ও নো, তুমি তেমন বলল না। কিংবা তা স্টিমারই থাকে কিন্তু হার ম্যাজেস্টির শিপ অফ দা লাইন হয় না। তুমি কি বলো ব্রিটেন ওন্ট সেইল দা সিস্।
কীবল বললো–ইনডিড, শি উইল। কিন্তু সেইল-এর অর্থ হবে তখন স্টিম অ্যাক্রস।
হরদয়াল বললো–জুলাই-এর টাইমসে এরকম একটা কথা সে দেখেছে বটে। কিন্তু তা কি সত্যি হবে। তা কি একটা সায়েন্টিফিক ফিকশনমাত্র নয়?
ডানকান টাইমস পড়ে না। কলকেতার ইংলিশম্যান বরং কেনে। কিন্তু ইতিপূর্বে সে কীবলের কাছে স্টিমারের উন্নতি সম্বন্ধে অবশ্যই জেনে থাকবে। তার কথায় বিস্ময়ের পরপরই যে কৌতূহলী অবিশ্বাস আসে তা দেখা দিয়েছে এখন।