ধরেছিস ঠিক। অন্য একজন বললো–আমার এতদিন মনে হতো রহিমুদ্দিন যেমন বলে, সেই ইবলিশের বাচ্চা তাই। এখন এবার রহিমুদ্দিনকে বুঝিয়ে বলবো–সেখানেও কাগজপত্তরের খেলা। তাছাড়া ধরো ঘুন বেনের জাত তো, অন্য কারো আত্মার ভালো কাগজ নিজের বলে হাতিয়ে নিতে পারে।
এক সরল গ্রামবাসী গাঁক গাঁক করে হেসে উঠলো। সামনে থেকে আর এক সরল গ্রামবাসী পিছন ফিরে বললো–তাই বুঝি ডানকানা কুঁদে বেড়ায়, চরণদা? তা, পিয়েত্রো কিন্তু ডানকানার মতো ছিলো না। তাছাড়া তাকে তো পোড়ানো হয়েছিলো। তার আত্মা ধরো যে ঘুমাবে কোথায়? আমার তোমার আত্মার মতোই নাক দিয়ে বেরিয়েই যদি যমদূতের হাতে না পড়ে থাকে, তবে চিতার আগুন নিবে অন্ধকার হতেই কী হয়েছে কে জানে। সে শিউরে উঠলো।
এখানে তাদের পথে আর একটি পথ এসে মিশেছে। চরণদাস বললো–সে পরে ভাবিস। মেয়েরা এই পথে আসবে। তোরা এগো, আমি বউ-এর জন্য দাঁড়াই।
হাসতে হাসতে চরণদাসের প্রথম সঙ্গী বললো–তা, চরণ, গাঁয়ে তোবউ একা তোমারই, কেমন নাকি?
চরণ বউ-এর অপেক্ষায় পথের পাশে সরে দাঁড়ালো হাসতে হাসতে।
.
০৫.
ভিড়ের প্রথম আর শেষ এক নয়। তখন আর চোপদারের সারিতে বাঁধা পথ নেই। বিশৃঙ্খলা, ঘোরাফেরা, ঠেলাঠেলি শুরু হয়েছে। ব্যাপার বুঝে চোপদাররা এগিয়ে এলো। পথ দাও বলে রূপচাঁদ চেঁচাতে লাগলো।
রানী সামনে, পিছনে সঙ্গিনী। তার অবগুণ্ঠন কিছু শ্লথ। তিলফুল নাসা, সুগঠিত চিবুক আর টানা চোখ দুটি, নাকি লোচন বলে, চোখে পড়ছে। থেমে দাঁড়িয়েছিলো তারা। পাশে চাইতে গিয়ে অদূরে রাজকুমারকে দেখতে পেলো সে। কেমন বিড়ম্বনা দেখো–নিঃশব্দ হাসিতে যেন এই কথাটা ছিলো। রাজকুমারের শিকারের পোশাক দেখে টাকুঁচকে উঠলো তার। কিন্তু রাজকুমারের চোখ নিজের উপরে দেখেবরং পাশ দিয়ে টানা অবগুণ্ঠনে চিবুকের আর কিছুটা ঢাকা পড়লো।
শিক্ষিত হাতি, ক্ষতি করে না; কিন্তু তার পায়ে তো চোখ নেই। সুতরাং তার গলার ঘণ্টা বেজে উঠতেই আপনি ভিড়টা এদিকে পাতলা হলো। তখন চত্বরের শেষ ধাপ থেকে নেমে রানী বললেন–এসো, নয়ন।
হাওদায় বসে আবার বললেন–রাজু বোধ হয় শিকারে চলেছে। উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললেন আবার–সাহেব দুটোর মধ্যে বুড়োটা বোধ হয় ডানকান।
রানীকে নিয়ে রামপিয়ারী তখন খানিকটা এগিয়েছে। রামপিয়ারীর জরির জামার চৌদোলা হাওদার কিংখাবের ফুলকারি আলোয় চমকাচ্ছে। জয়নাল কিছু পিছনে। পাশে একটা গলিপথ। জয়নাল দাঁড়িয়ে পড়ে একটা গাছের ডাল ভাঙলো। মাহুত ডাঙ্গস ঠুকলো তার মাথায়। যেন হাসলো এমন ভঙ্গিতে মুণ্ডু ঘুরিয়ে জয়নাল পাশে সেই গলিপথটাকে ধরলো একটু দ্রুতগতিতে। ফলে সিঁদুরে খড়িতে আঁকা তার গায়ের পদ্মগুলো অস্পষ্ট হচ্ছে।
রানী আর একবার কথা বললেন, বাগচীমাস্টারের স্ত্রীর কাছে শুনেই সব ব্যবস্থা হয়েছে। নিশ্চয় লাঞ্চোর?
পাড়ছাড়া দুধ-গরদের ঘেরে তাকে অন্যমনস্ক দেখালো। উপোস করে আছে, মনে হলো সঙ্গিনীর, হয়তো সেজন্যই একটু শুকনো দেখাচ্ছে। আর এতক্ষণে তা ঠাহর হলো। রানীর সঙ্গিনীর অবগুণ্ঠন শ্লথ, নিচে থেকে বর্ণটা ঠাহর হলো, তার জড়োয়ার কন্ঠি কলার ঝিকমিক করলো।
.
০৬.
লাঞ্চ শুরু হলো ভাজা মাছ দিয়ে। লাঞ্চ বটে নাম, আয়োজনটা ডিনারের। অন্যদিকে যেন হালের কটেইল পার্টির অভ্যাসও আছে। ছজনের টেবিল, কিন্তু মাঝখানে সাজানো বোতল বোধ করি এক ডজন এবং তা নানা আকারের। সেগুলোকে ঘিরে কয়েক ডজন ঝকমকে কাঁচের গ্লাস। জলের গ্লাসই বরং অনুপস্থিত। সাদা ব্রোকেডের টেবল ক্লথে ঝকঝকে হেমন্ত দুপুরের আলো।
০২. পিয়েত্রোর বাংলো
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পিয়েত্রোর বাংলোর একটা সাধারণ লাঞ্চ অবশ্যই ছিলো না। আমন্ত্রণপত্রে স্বাক্ষর ছিলো হরদয়ালের। তা কিন্তু রাজবাড়ির পক্ষ থেকেই হয়ে থাকবে এই ভেবেছিলো ডানকান, কারণ উপলক্ষ তো ফরাসডাঙায় রানীমার শিবমন্দির স্থাপন। প্রটোকল নিয়ে খুব একটা চিন্তা। করেনি ডানকান। কেননা মরেলগঞ্জ নীলকুঠির ম্যানেজার হিসাবে সে নিজে রাজবাড়ির ঠিক কার সমকক্ষ এ নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট বিধান নেই। তাছাড়া এটা এমন অনেকদিন থেকে চলে আসছে রাজবাড়ির নিমন্ত্রণ আসে হরদয়ালের কাছ থেকে। এবং খানাপিনা হয়। দেওয়ানকুঠিতে। সেও তো হরদয়ালের কুঠিই। অবশ্য রোজ রোজ হয় না। রানীমার জন্মতিথি উৎসবে হয়।
প্রথমেই ডানকান বোতলের দিকে আঙুল তুলেইঙ্গিত করলো। বাবুর্চির সাগরেদ এগিয়ে এসে নির্দেশমতো বোতল খুলে গ্লাসে ঢেলে দিলো।
এ ব্যাপারে সম্ভবত আমাদের আশ্চর্য হওয়া সঙ্গত নয়। কারণ এ সময়ের কাছাকাছি কলকাতায় মদ্যপান নিবারণী সমিতি স্থাপনের কথা শোনা যায় বটে;প্রকৃতপক্ষে সেটা তখন তিনবোতলী মানুষদের ভিক্টোরীয় যুগ। তাদের উদরও নিতান্ত উদার ছিলো। টেবিলের পায়া জড়িয়ে ধরে অনেকে ডিনার শেষ করার খ্যাতি অর্জন করতেন তখন।
টেবিলটা গোল। ঢুকতেই চোখে পড়ে কেটকে। পরনে চকোলেট রঙের স্কার্ট ব্লাউজ। মাথায় সাদা বনেট, তাহলেও তার লাল চুল কিছু চোখে পড়ছে। কুনুই অবধি সাদা গ্লাবস ছিলো, এখন পাশে খুলে রাখা। তার বিপরীত দিকে তার স্বামী বাগচী-চন্দ্রকান্ত এজ বাগচী। হালকা কালো ওরস্টেডের ব্রিচেস, কালো ভেলভেটের কোট, গলার সাদা বো। তার চিবুকে এখন দু-চারটে সাদা দাড়ি চোখ পড়ে। তাকে কালোই দেখায়।