ডগরের ঘোড়াই পথ করছিলো। চোপদারদের দুই সারি সেই ফাঁকে ঢুকে ডাইনে বাঁয়ে সরে সরে চাপতেই ভিড়ের মধ্যে গলিপথটা তৈরি হলো। সেই গলিপথের মাথায় হাতি থামলো। প্রথমে রামপিয়ারী বসলো। মাহুত নেমে রেলিংদার কাঠের সিঁড়িটা নামিয়ে হাতির গায়ে হেলান দিয়ে ধরলো। রানী এবং তার সঙ্গিনী আগে পিছে নামলেন।
তাঁরা এগিয়ে গেলে রাজচন্দ্র নামলো তার হাতি থেকে। রূপচাঁদ এগিয়ে এসেছিলো। তার হাতে বন্দুক দিয়ে রাজচন্দ্র মন্দিরের চত্বরের দিকে এগিয়ে গেলো।
এতক্ষণ চত্বরটি খালি ছিলো। সিঁড়ি বেয়ে রানীমা উঠতেই চত্বরের নিচে থেকে পুরনারীরা উলু দিয়ে অনুসরণ করলো। তাদের কারো কারো কাঁখে ঝকঝকে নতুন ঘড়া। তারা এগিয়ে যেতেই অন্য এক সিঁড়ি দিয়ে স্বগ্রামের আমন্ত্রিত পুরুষরা উঠতে লাগলো চত্বরে। তখন জনতার মধ্যে গুঞ্জন উঠলো–দেখা যাচ্ছে, দেখা যায়, আসছে ওই। কারা শঙ্খ বাজালো৷ নিকষের থামের মত শিবলিঙ্গ বেশ দূর থেকেই দেখতে পাওয়ার কথা। ওদিকের আর এক সিঁড়ি দিয়ে হরদয়াল আর ডানকানকে উঠতে দেখা গেলো। তাদের ঠিক পিছনে বাগচীমাস্টার আর তার পাশে নতুন এক সাহেব। ভিড়ের মধ্যে ফিসফিসানি শোনা গেল বাগচীর শ্বশুরকুলের নয়তো? নাকি ডানকান বেটার মেতোভাই। সাধারণ, রবাহূতরাও একে-দুয়ে চত্বরে উঠতে শুরু করলো এবার।
ততক্ষণে মিস্ত্রিরা মন্দিরের ভিতরে ঢুকে গিয়েছে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়েছে। ভিড়ের থেকে ছোকরা বয়সের কয়েকজন বুদ্ধি করে কাছের এক গাছে গিয়ে চড়লো। তারপর গাছ ভরে উঠলো মানুষে।
মন্দিরের দরজার সামনে, অর্থাৎ যেখানে দরজা বসবে, লিঙ্গকে স্নান করানো হলো। মিস্ত্রিরা ততক্ষণে লিঙ্গ বসানোর গোল ফাঁদটাকে ঠিক করেছে। মন্দিরের ঘরে তখন নামলেন রানী তার সঙ্গিনীকে নিয়ে তার হাতেই পূজার উপকরণ। রানী ভিড়ের আর একজনকে ডেকে বললেন–এসো, বড়গিন্নি।
পঞ্চতীর্থের মাটি বার করে সে ফাঁদে সেই মাটি বসানো হলো। প্রধান মিস্ত্রি বললো–—এবার–
রানী বললেন–একটু রসো।
পিছন ফিরে বললেন–দাও এবার যা এনেছে।
রানীর সঙ্গিনী ফুলের সাজি থেকে একটা ছোট রুপোর বাটি দিলো মিস্ত্রির হাতে। সে বাটি যেন রক্তচন্দনে টৈটুম্বর। সঙ্গিনীই মিস্ত্রিকে বলে দিলো–ওটার উপরে স্বর্ণের শতদল বসবে, তার উপরে শিবলিঙ্গ।
শোনা যায় মিস্ত্রিরা নলের বংশধর এবং হাতে যখন করনি তখন জোগান যেই দিক বাঁ হাতেই তা ধরে। এ নিয়ে সুগ্রীব না কার সঙ্গে একবার হাঙ্গামা হুজ্জত বেধেছিলো। তাতে কিন্তু ধারা বদলায়নি। তীর্থের মাটি সমান করে, করনি দিয়ে গোল গর্ত করে বাটিটাকে বসিয়ে বাঁ হাতেই রানীর সঙ্গিনীর দু হাতে ধরা অত বড় স্বর্ণপদ্মটাকে নিলো সে। সেটাকে বসিয়ে বললো–এবার তাহলে–
দু-তিনজনে মিলে নিকষের লিঙ্গটাকে সোজা করে ধরলো। প্রধান মিস্ত্রি নিজেও হাত লাগালো। মেয়েরা উলু দিয়ে উঠলো। ভিড় শিবের নামে জয় জয়কার দিলো। ততক্ষণে কুচো ইট আর মশলার জমাট গুঁজে করনির মাথা দিয়ে খুঁচিয়ে পোক্ত করতে লেগেছে মিস্ত্রিরা। ফুল ছড়িয়ে দিয়ে রানী পিছন ফিরলেন।
একেই তাহলে শিব প্রতিষ্ঠা বলে। এই কি প্রথা–এরকমই মনে হলো দর্শকদের।
প্রথার কথা কজনেই বা জানে। রোজ তো আর হয় না। দুএকজনের স্মৃতিতে অন্য কোনো কোনো শিবপ্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু সে নিরিখে কি আজ যা হলো তার বিচার হয়! রাজপুরোহিত ছিলেন। আমন্ত্রিতদের মধ্যে বৃদ্ধ শিরোমণিমশায় ছিলেন। রাজপুরোহিত প্রথমে কৌশলে কাটলেন–তা বাপু, আমি শিবতন্ত্র জানি না। এ শিবের জন্য তো নতুন পুরোহিতই এসেছে। পরে আর একটু কৌশল করে বললেন–তোমরা যদি অন্যত্র অন্যরকম দেখেই থাকো সে কি রাজবাড়ির ব্যাপার? আমি তো বলি বাপু, তোমরা যদি প্রতিষ্ঠে করো, আর আমাকেই ডাকো, এখন জানা রইলো, এমন বিধানই দেবো। শিরোমণি অত সহজে মুখ খোলেন না। মনে মনে শাস্ত্র ঘেঁটে শিবলিঙ্গের মূলে রক্তচন্দনেরও আধার বসানোর যুক্তি খুঁজলেন। অশাস্ত্রীয়ই বোধ হলো তার কাছে। শিবপূজায় শ্বেতচন্দনই বিধেয়।
ভিড়ের টানে একটা মেলা বসে গেলো। জিবেগজা আর আর দই, মুড়কি মোয়া মিঠাই, জোলাকি মাটা আর গামছা, বাঁশের দাঁড়ে বসা শোলার পাখি। মেলার টানেই মেলা চললো যেমন চলে, যদিও মন্দিরের চত্বর খালি হয়ে আসছে।
.
০৪.
মেলা থেকে ফিরতে ফিরতে গ্রামের পোস্টমাস্টার চরণদাস বললো–ছিলো ফরাসী সাহেবের হাওয়াঘর, হলো শিবমন্দির। লাও।
তার এক সঙ্গী বললো–এতদিনে পিয়েত্রোর আত্মার শান্তি হলো গো।
চরণদাস বললো–সেবাপু খেস্টানি আত্মা। ভারি মজেসে ঘুমোতে লেগেছে এখন। কোন ক্ষেতিবৃদ্ধি নেই। সেই কবে রোজকিয়ামৎ হবে তখন দেখা যাবে।
সঙ্গীরা নতুন খবরের আকর্ষণে ঘিরে ধরলো চরণদাসকে।
একজন বললো–ইনসাল্লা, বলিস কী রে? তাচরণ তোর জানারই কথা। তুই তো আবার খেস্টান বাগচীমাস্টারের সাগরেদ।
অন্য একে বললো–কী যেন রোজ বললে? তাতে কী হয়?
চরণদাস হেসে বললো–সে ভারি মজার। সেই একদিন, তা সে যে কত লাখ বছর পরে আসবে এখনো কেউ জানে না, সেদিন নাকি ভগবান বিচার করবেন।
মানে লাখ লাখ বছর ধরে কোনো বিচারই হবে না?
চরণদাস ঠা-ঠা করে হেসে উঠলো। বললো–তাই তো। বলতে পারো ভগবানের এজলাশে তামাদি হয় না। কিন্তু কোটি কোটি মানুষের পাপের হিসাব লাখ লাখ বছর ধরে কে রাখে কে জানে। আমার তো মনে হয় ডানকান বেটা বুঝে নিয়েছে ওর আত্মার বিচারের কাগজপত্তর ততদিনে সব নিপাত্তা হয়ে যাবে। আর থাকলেও কিছু তা পড়া যাবে না।