রূপচাঁদ খুক করে কাশলো।
-কে? রূপচাঁদ? হরদয়াল মুখ তুলো-তুমি ছাড়া আর কে?
রূপচাঁদ বললো–রানীমা একবার ডেকেছেন, আজ্ঞে।
-এখনই?
–আজ্ঞে, খাসকামরায়।
–আসছি, বলো।
রূপচাঁদ গেলে পোশাক পাল্টালো হরদয়াল। মশালচিকে নির্দেশ দিলো শোবার ঘরে আর লাইব্রেরিতে আলো যেন বেশি না হয়। আলনা থেকে বালাপোশ নিয়ে হরদয়াল রাজবাড়ির দিকে গেলো।
রানীর খাসকামরায় তখন ঝাড়ে আলো জ্বলছে। বোধ হয় মৃদু মৃদু বাতাস একটা আছে ১৮৬০-এর শেষে হেমন্তের ঠাণ্ডাটাকে বাড়ানোর মতো। কিন্তু বালাপোশ অথবা শাল সত্ত্বেও বিধবে এমন নয়। রানীর পায়ের তলায় লাল গালিচা। তার উপরে আঙুলের ডগা চোখে পড়ে। গায়ে পান্না রঙের শাল। রানী বললেন–এসো হরদয়াল, তোমাকে ডেকেছি আমি। যেন বা হাসলেন, বললেন–বসো।
রানীর হাসি সম্বন্ধে আলোচনা হয় না। কিন্তু তিনি যখন মুখ টিপে হাসেন তখন যে বাঁ দিকে সামান্য টোল খায় তো এতদিনেও হরদয়াল জানতো না। এজন্য, রানী না হলে বলা যেতো, হাসিটাতে একটা অল্পবয়সী ভাব জড়িয়ে থাকে। তার চুল টেনে তুলে বাঁধা, কিন্তু পাক দেখে অনুমান একসময়ে ঝাপটা ঢেউ তুলে থাকতো তা কপালের উপরে।
হরদয়াল বসলে তিনি বললেন–ব্যাপারটা একটা উৎসব। কথার সূচনা করে চোখ তুললেন তিনি, তাঁর টানা চোখের পক্ষ্মগুলো সাধারণের চাইতে বড়ো। মনে হয় উপরদিকে ঈষৎ বাঁকানো।
বললেন–তোমার মনে পড়ে হরদয়াল, মরেলগঞ্জে কালীপূজা হয়েছিলো। ডানকান করেছিলো। তুমি গিয়েছিলে। রাজুর নিমন্ত্রণ ছিলো। সে যায়নি।
বছর দু এক আগে ডানকান কালীপূজা করেছিলো, মরেলগঞ্জের নীলকুঠির ইংরেজ কুঠিআল ডানকান হোয়াইট। পূজা অবশ্য হয়েছিলো তার দেওয়ান মনোহর সিংহের আট চালা চণ্ডীমণ্ডপে। আর ওদিকে যখন পূজা এদিকে ডানকানের বাংলোয় তখন আতসবাজি ফুটছে, মদ আর নাচ চলেছে।
হরদয়ালের কাছে ব্যাপারটা এখনো কিম্ভুত। ঠিক হাস্যকর নয়, কেননা, শোনা যায় সেবারে সেই সিপাহী বিদ্রোহের অবসানে কলকেতার ফোর্টের কোন কোন জাঁদরেল ইংরেজও নাকি কালীঘাটে পূজা দিয়েছিলো।
রানী বলে গেলেন–পিয়েত্রোর হাওয়াঘরে শিবমন্দির হচ্ছে শুনছো বোধ হয়? আগামী বুধবারে, আর সাতদিনও নেই, বিগ্রহ স্থাপিত হবে। একটা উৎসব তো। ডানকানকে নিমন্ত্রণ দিলে হয়?
হরদয়াল বললো–শিববিগ্রহ স্থাপনে
থামলো সে। (এরকম মতামত দিতে পারতো দেওয়ান, সে আর দেওয়ান নয়) বললো– আবার দিনের বেলায় তো?
রানী বললেন–হ্যাঁ, নিমন্ত্রণ মন্দিরে হবে না। তোমার ভয় নেই। উপরন্তু এখনই প্রাণ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না যে ছোঁয়া লাগবে। (রানী কি হাসলেন!) পিয়েত্রোর বাংলোয় হতে পারে। দুপুরে একটা দুটোয় নাকি ডানকানেরা একবার খায়। বাগচীবাড়ি থেকে জানা গেলে তাকে নাকি লাঞ্চো বলে। ডানকানকে সপরিবারে বলল। মনোহরকে বলবে কিনা ভেবে। তোমাদের পক্ষে সস্ত্রীক বাগচী থাকবে। রাজু থাকতে পারে। তুমি থেকো। নায়েব-ই রিয়াসৎ থাকবেন না।
রানী উঠলেন। আসনের পিছনের পর্দা ঠেলে অন্তরে যেতে যেতে দাঁড়ালেন, বললেন, মরেলগঞ্জে কীবল নামে এক ছোকরা সাহেব এসেছে, জানো? হরদয়াল নিজের অজ্ঞতায় বিব্রত হলো। রানী হেসে বললেন, তাকেও বলো। দরবার শেষ হলো।
কখন কী মনে আসবে, কোনটা আগে আসবার সুযোগ নেবে তা বলা যায় না। লাঞ্চো এই শব্দটা মনে এলো হয়দয়ালের। উচ্চারণটা বিকৃত; কিন্তু তা কি ইচ্ছাকৃত কিংবা না জেনে? কৌতুক বোধ করলো হরদয়াল। তারপর তার মনে এলো নায়েব-ই-রিয়াসৎ এই ভারি শব্দটা। আর কেউ দেওয়ান হয়নি। পদটা শূন্য আছে। কিছুদিন আগেও তাকে সদরনায়েব বলা হতো। এখন তার দায়িত্ব বেড়েছে, নামটাও বদলেছে। দেওয়ানের পরিবর্তে সদর-ই-রিয়াস। ও, হ্যাঁ, কীবল নামে কোনো ছোকরা যদি এসে থাকে তার খোঁজ জানা তার কর্তব্য নয় আর এখন। রানী ও নায়েবের চরেরা তা করবে।
.
০৩.
সে যাই হোক, এর ফলে বিগ্রহস্থাপনের দিনটিতে ভিড়টা বেশ দর্শনীয় হয়ে উঠলো। আমন্ত্রিতদের, কর্মচারী আমলা কারিগরদের সঙ্গে প্রচুর সংখ্যক রবাহূত যেমন এদিকে, ওদিকে তেমনি পিয়েত্রোরকুঠিতে লাঞ্চোর জন্য বাবুর্চি খানসামা, লাঞ্চে নিমন্ত্রিত নীলকুঠির সাহেব ডানকান, তার দেওয়ান মনোহর সিং, এপক্ষের বাগচীমাস্টার, তার স্ত্রী (ইংরেজ স্ত্রী ক্যাথারীন, সংক্ষেপে কেট), উকিল হরদয়াল তো বটেই, ডানকানের অতিথি সদ্য বিলেত-আগত কীবল নামে এক ছোকরা সাহেবও ভিড়টাকে বিশিষ্ট করে তুললো।
ভিড় যখন জমে উঠেছে, বেলা দ্বিপ্রহরের কিছু আগে, রানী এলেন। আগেপিছে দুটো হাতি। হাতির আগে ঘোড়া। ঘোড়ার পিঠে দুপাশে ঝোলানো লালসালুর ঝালরদার দুই দামামা, দুপাশ থেকে দুজন তা পিটে চলেছে। তাদের পিছনে চোপদার দুই সারিতে। হাতি দুটির পিঠে হাওদা। রামপিয়ারী আগে। তার ঝুটো জরির কাজ করা লাল বনাতের জামা মাটি ছোঁবে যেন। তার চৌদোলা হাওদায় রানী। তাঁর পাশে একজন মহিলা। ঠিক চেনা যায় না এমন অবগুণ্ঠন। কিন্তু রানীর পাশে মানায় বটে। হাওদার বাইরে রেলিং ধরে রূপচাঁদই। গায়ে তার লাল পটুর পিরহান। বুকে আড়াআড়ি বাঁধা নীল পশমী ধোকড়। মাথায় গাঢ় নীল মলমলের পগগ। পরের হাতিটি জয়নাল। একটু বয়স হয়েছে। রামপিয়ারীর দেড়া উঁচু, দাঁতাল। খোলা হাওদায় রাজু, রাজকুমার রাজচন্দ্র। রাজুর পরনে গলাখোলা ইংরেজি ব্লাউজ কামিজ। হাতে বন্দুক।