পরের দিন সকালেও রাজচন্দ্রকে বাগচী নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলো। রাজচন্দ্র একটু শক্ত হয়ে বলেছিলো, কাল রাতে আপনি শেঠানীর সঙ্গে আলাপ করছিলেন আমি শুনেছি। এই মহাপ্রস্থানকে আমার সুইসাইডাল মনে হয়।
তখন শেঠানীর সেই মৃদু গলা আবার শোনা গিয়েছিলো-রাজাসাহেবের ইংরেজিটা আমি বুঝলাম না। কিন্তু মহাপ্রস্থান আগেও হয়েছে।
-সে তো কাব্যে, রাজচন্দ্র বলেছিলো।
পর্দার ওপার থেকে শেঠানী সেই একবার তাকে সরাসরি কিছু বলে ফেলেছিলো। রাজাসাহেব, কাব্য কি মিথ্যা? কাব্যে যা সম্ভব কোনো কোনো মানুষ নিজের জীবনে তেমন কিছু করতে চাইবে। সেই সময়েই পর্দার নিচে বাদামী সিল্কে ঘেরা পা দুখানা আর তার মলদুটো আবার চোখে পড়েছিলো রাজচন্দ্রর।
আর সে কথাটা বোধহয় বাগচী বলেছিলো আলমোড়ায় ফিরে যেতে। রাজচন্দ্র নেমে এসে বাগচীকে বালুয়াকোটেই পেয়েছিলো। বলেছিলো, শেঠানী নামতে দেয়নি। বাগচী বলেছিলো, মনে আছে রাজকুমার, সেই চতুর্দশীয় সৌরভ? আমরা ভুলে যাই সেই চতুর্দশীর মনেও ব্যূঢ়োরস্ক, বয়োবৃদ্ধ, জ্ঞানবৃদ্ধ এক স্বপ্ন থাকতে পারে। এই পাহাড়ে বিশ বছর কাটিয়ে আমার মনে হয়, এই হিমালয়কে, হাজার হাজার বছর ধরে, তেমন একজন পুরুষ বলে কল্পনা করা হয়েছে। তারপর একটু হেসে বলেছিলো, জাঁ পিয়েত্রোর ছবি আপনার যা মনে আছে। তাও কি এক বৃদ্ধের নয়?
টাইটা বাঁধলো রাজচন্দ্র নিখুঁত করে। গলাটা উঁচু করে আয়নায় বাঁধনটাকে লক্ষ্য করতে করতে রাজচন্দ্র ভাবলো, আলমোড়া থেকে সে অবশ্য বাগচীর টেলিগ্রাম পেয়ে অবাক হয়নি।
-ও না, তা সে ভাবছিলো না। রানীমা যে অবিরত পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরতেন ইদানীং, তার ব্যাখ্যা কি বাগচীর ও কথায় হয়?
.
০৩.
ডিনারের পরে গেস্টরা শুতে গেলো। সার রাজচন্দ্রর মনে হলো এখনো তার অষ্টম গেস্ট সেই কুমারনারায়ণের শোবার ঘর ঠিক করে দেওয়া হয়নি। হৈমী সে ব্যবস্থা করবে ভেবে সময় কাটানোর জন্য সার রাজচন্দ্র তাকে নিয়ে নিজের শোবার ঘরে গেলো। বললো–বোসো, গল্প করি। তুমি খেতে বসে যে বলছিলে ইংরেজ তোমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে, তা কি অন্তর থেকে বলেছিলে?
কুমারনারায়ণ হেসে বললো–ডিমোক্র্যাসি, লিবার্যালিজম,ন্যাশনালিজম,এগুলো তো শিখেছি। তাছাড়া বোধ হয় আন্দোলন করতেও।
রাজচন্দ্ৰ হেসে বললো–এটা কী রকম কথা হলো?
কুমার হেসে বললো–দু রকমে। প্রথমত, ওদের দেশের আন্দোলনের ঐতিহ্যটার পরিচয় দিয়ে; দ্বিতীয়ত, ভালো আদর্শ তুলে ধরে সেই আদর্শ নিজেরাই ভেঙে দিয়ে বরং দমনমূলক এবং পক্ষপাতমূলক আইন তৈরী করে। ভিকটোরিয়ার ডিক্লারেশনের আদর্শ নিজেরা মানেনি। একটা উদাহরণ দেখুন, তার ফলেই ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে আন্দোলন, লালমোহন ঘোষের লন্ডনে যাওয়া। আর্মস অ্যাক্ট এবং ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট নিয়ে আন্দোলন তত দমনমূলক ও পক্ষপাতমূলক আইনের বিরুদ্ধেতা কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক চেতনাকে বাড়িয়েছে। এখন তো ইলবার্ট বিলের ব্যাপারটা দেখতেই পাচ্ছেন।
সার রাজচন্দ্র আবার হেসে বললো–তুমি খেতে বসে ওদের বলছিলে বটে ইংরেজদের ইলবার্ট বিল বিরোধী আন্দোলনের জন্য তুমি সুখী। তোমার এ মন্তব্য আমার গেস্টদের আনন্দিত করেছে।
কুমার হেসে বললো–আপনি বলছেন, ছলনা করা উচিত নয়। কিন্তু আমি সত্যি সুখী। ওদের আন্দোলনের জয় না হলে সুরেন্দ্র ব্যানার্জির অল ইন্ডিয়া ন্যাশন্যাল ফান্ড তৈরী হতো না। সারা ভারতবর্ষ থেকে প্রতিনিধি নিয়ে যে ইন্ডিয়ান ন্যাশন্যাল কনফারেন্স হতে চলেছে, তাও হতো না। এই অল ইন্ডিয়া, সারা ভারতবর্ষ সর্বভারতীয় শব্দগুলোই সবচাইতে মূল্যবান।
রাজচন্দ্র বললো–তুমি, মনে হচ্ছে, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির পক্ষপাত। এইসব ব্যাপারেই কি কলকাতা এসেছিলে?
কুমার একটু দ্বিধা করে বললো, কিছুটা তা বলতে পারেন। আবার হেসে বললো, আপনাদের জেনারেশনে কিন্তু এই সর্বভারতের বোধটা ছিলো না। সে হাসলো। বললো–সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে, তখন আপনাদের বয়স সম্ভবত আমার এখনকার বয়সের মতো ছিলো, আপনারা কিছু করতে পারেননি, কারণ তখন মারাঠা, শিখ, বাঙালি, হায়দ্রাবাদী, দিল্লীওয়ালা এইসব স্বার্থ পৃথক ছিলো। কলকাতা আসার অন্য কারণ, কিছুদিনের মধ্যে বিলেতে যাবো। বাঙালি হয়েও এর আগে বাঙলা দেশে আসিনি, তাই ঘুরে যাওয়া।
রাজচন্দ্র বললো–তোমার হাই উঠছে, মিস্টার কুমার। আচ্ছা, না হয় তুমি এই ঘরেই শোও। এ ঘর কি তোমার পছন্দ হচ্ছে?
কুমার চারিদিকে চেয়ে বললো–আমার মনে হচ্ছে, প্রিন্সলি। বোধহয় এটাই রাজকীয় বাড়িতে সব চাইতে রাজকীয়। বরং সঙ্কোচ হচ্ছে, হয়তো এটা আপনার নিজের ব্যবহারের।
-সে কিছু নয়। কাল তোমার মামাবাড়ির গল্প শুনবো। মরেলগঞ্জে একাধিক পুকুর থাকার কথা। নীলের জন্য জল লাগে। রাজচন্দ্র হাসলো। বললো–মামাবাড়ি খুঁজে পেতে পুকুর মেপে বেড়াতে না হয়! তার চাইতে এক কাজ করো। আমি লোক পাঠিয়ে বাড়িটা খুঁজে বার করতে পারি তোমার জন্য। তোমার কম্পানি বেশ লাগছে। …আরে দ্যাখো, সেই থেকে তোমাকে মিস্টার কুমার বলছি। কুমার তত তোমাদের উপাধি নয়, নিশ্চয়? নাকি রাজনৈতিক কারণে ইকগনিটো?
কুমারের মুখটা মুহূর্তের জন্য লাল হলো। কিন্তু তখনই সে বিড়ম্বনাটা পার হলো। হেসে বললো, আধুনিক কালে পূর্বপুরুষের নাম সবক্ষেত্রে না করাই ভালো। মনে করুন কেউ যদি রাজার ছেলেই হয়ে থাকে, তবে সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে সেই রাজা কী করেছিলো তাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। হয় সেই রাজা বিদ্রোহে প্রাণ দিয়েছে, ফলে রানীকে আত্মগোপন করতে হচ্ছে। অথবা সেই সময়ে সেই রাজা এমন কিছু করেছে যে তার পুত্রদের লজ্জায় থাকতে হয়, সেই রাজা বেঁচে থাকলেও এখন হয়তো এমন একজন প্রৌঢ় যার মধ্যে রাজাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। আমাদের উপাধি রায়। আসলে এমন কি হয় না যে আজ আমাকে যেমন দেখে আমার কম্প্যানি ভালো লাগছে, এখন থেকে বিশ বছর পরে আবার যদি দেখা হয় আমাকে আপনার তেমন না লাগতেও পারে। তাহলেও যেহেতু মরেলঞ্জের সঙ্গে আমার মায়ের যোগ, সুতরাং আমারও যোগ, আমি কিন্তু আপনার এস্টেটের ব্যারিস্টার হওয়ার ইচ্ছা এখনই প্রকাশ করছি। সার রাজচন্দ্ৰ হেসে বললো–বিউটিফুল! আচ্ছা, এবার বিছানায় যাও। কাল দিনের আলোয় মামাবাড়ির খোঁজ কোরো।