হ্যাঁ, তা তো তিব্বতে।
–নিশ্চিয়। লিপুধুরাতে পৌঁছেতেই হাত পা অবশ হয়ে যায়। প্রচুর শীতবস্ত্র না থাকলে মৃত্যু হওয়া অসম্ভব নয় এই শীতে। আর পথ তো পাথরে পাথরে পা রেখে চলা, ভালো গাইড না থাকলে আর তারা সাহায্য না করলে আমাদের মতো মানুষেরা এক পাও বাড়াতে পারবে না। আর মানস-সরোবর সে তো শুনেছি বরফে চলা আর প্রতি মুহূর্তে পড়ে প্রাণ হারানোর ঝুঁকি নয় শুধু, ডাকাতের হাতে পড়ার আশঙ্কা।
আগ্রহ বোধ করে কুমার বললো–আপনি সি-অফ করার কথা বলছিলেন, ও পথে সি অফ মানে? ওটা কোথাকার পথ?
হৈমী ভাবলো কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা, কিন্তু পরে সেই গল্পটার আবেগই যেন নিজে থেকে তার মনে আত্মপ্রকাশের চাপ দিলো। সে বললো–তিনি একজন বৃদ্ধা, না না, প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন বৃদ্ধা রানী। তিনি মানস-সরোবরের উদ্দেশে গেলেন কিনা। বয়স প্রায় ষাট হয়েছে। সঙ্গে দু-একজন মাত্র লোক। তা সেই ভৃত্যটিও বৃদ্ধ। গাইডটা অবশ্য মাঝবয়সী। পাহাড়ী ঘোড়ায় হয়তো এখনো চলেছেন। এই দারুণ শীতে আর সেই নিঃসঙ্গ বরফ-ঢাকা পাহাড়ে দিনে তিন-চার মাইলের বেশি কি আর চলা সম্ভব? আর রোজ কি চলতেও পারবেন? হৈমী তার সাদা শালটাকে টেনে হাত দুটোকে ঢেকে নিলো।
কুমার বললো, বাপরে! তিনি খুব ধর্মপ্রাণা? এ যে মহাপ্রস্থানের মতো! এ রকম গেলে তো আর ফেরার সম্ভাবনাই থাকে না। আশ্চর্য কিন্তু, নয়?
.
কিন্তু ডিনারের ড্রেসিং গং বেজে উঠলো। সার রাজচন্দ্র, গেস্টদের ঘরে যখন ভৃত্যরা ড্রিংকসের ট্রে নিয়ে ঢুকছে, প্রত্যেক দরজার সামনে একবার করে হাসিমুখ দেখিয়ে হ্যালো জো, হেল্প ইয়োরসেলফ বিলি ইত্যাদি বলে দোতলায় ফিরে বাথে ঢুকেছিলো। গরম বাথটাকে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে ল্যাভেন্ডার ঘ্রাণটাকে উপভোগ করছিলো। ড্রেসিং গং-এর শব্দে বাথটাব থেকে উঠে পড়লো। এতগুলো গেস্ট! কিন্তু সেই গরম থেকে উঠেই স্বগতোক্তি করলো, কী ঠাণ্ডা, কী শীত! সে তাড়া তাড়ি শরীর ঘষতে লাগলো টাওয়েলে। মনে মনে বললো, বাব্বা, এ যে লিপুধুরা! গায়ে জামা চাপিয়ে তার মনে হলো, তা অবশ্য নয়। লিপধুরায় সেদিন তুষার পড়ছিলো। সাদা ছাড়া কোনো রংই ছিলো না চারিদিকে। সে তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরতে লাগলো। তার মুখটা উদাসীন নিস্পৃহ, কিন্তু চোখ দুটো যেন স্বপ্নাচ্ছন্ন কিংবা সজল। ঠাণ্ডা লাগলে যেমন হয়। তার চোখ দুটোয় কালো গ্লাসে ঢাকবার আগের কয়েক মিনিটেই, সেই সাদা দেখে, ঠাণ্ডা লেগে কষ্ট দিচ্ছিলো।
কিন্তু লিপুধুরায় পৌঁছে সে কাউকেই দেখতে পায়নি। তার গাইড অনেক চেষ্টায় বরফে বারো আনা ঢাকা ছোট গোয্যায় একজন লামাকে পেয়েছিলো। সেই লামাই বলেছিলো, এখন তো সব লোকই আসকোটের দিকে নেমে গিয়েছে। তবে সকালে একটিমাত্র দল তিনটি ঘোড়া নিয়ে লিপুধুরা ছেড়ে তাকলাখারের দিকে রওনা হয়েছে, নিষেধ শোনেনি। যদি বরফ পড়ার আগে পুরাং-এর জং-এ আশ্রয় পায়। সার রাজচন্দ্রর কঠিন মুখে গগল্স-ঢাকা চোখ থেকে জলের ধারা নেমেছিলো।
সারা পথটাই এমন হয়েছে। কখনো একবেলা আগে, কখনো একদিন আগে, রানীমার এগিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিলো। স্থানীয় দুঃসাহসী লোকেরা অতি প্রয়োজনে যাওয়া-আসা করছিলো, নতুবা সাধারণ গ্রামবাসীদের অধিকাংশ তখন নিচে নেমে গিয়েছে। উপায়হীন শীতে বন্দী যারা ছিলো তারাও একটা তিনজনের দলকে ক্রমশ উপরের দিকে চলতে দেখেছে। বালুয়াকোটের প্রধানের অতিথিশালায় পৌঁছে সে আর বাগচী সেই শেঠানীর কাছে শুনেছিলো, আগের দিন রানী রওনা হয়ে গিয়েছেন। লিপুধুরায় তবু তো সময়টা কমে একবেলার তফাতে দাঁড়িয়েছিলো। শেঠানী বাগচীর মারফত জানিয়েছিলো রাজচন্দ্রর ফিরে যাওয়া উচিত হবে। কারণ তার ধারণা কারো সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা থাকলে সেই দলটা থেকে যেতো সেদিনও। সেই রকম কথাই হয়েছিলো রাতে। সকালে উঠে সেই রানী যখন রওনা হওয়ার জেদ করলেন, তখন শেঠানী ঘোড়া তিনটে বদলে দিয়েছে আর এখানকার সবচাইতে ভালো গাইডটাকেই দিয়েছে।
রাজচন্দ্রর ইচ্ছা ছিলো, শেঠানীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলে, কিন্তু বাদামী সিল্কের অবগুণ্ঠনে ঢাকা সেই ধনী শেঠানী পর্দার আড়ালেই ছিলো। বাগচীর রোগী বলে তার সঙ্গে কথা বলে, অন্যের সঙ্গে কথা বলবে কেন? রাজচন্দ্র পর্দার নিচে তার পা দুখানা দেখেছিলো আর পর্দা একবার একটু সরে গেলে একটামাত্র চোখ।
লিপুধুরার সেই লামা বলেছিলো, বরফ আরো বেশি পড়লে কালাপানি দিয়ে নামা যাবে । আপনারা নেমে যান এখনই। শেঠানীও তেমন বলেছিলো, আপনারা আর উঠবার চেষ্টা করে নেমে যান।
বালুয়াকোটে রাত্রিতে খেতে বসেছিলো, সে আর বাগচী। বাগচী বলেছিলো, আলমোড়ায় সংবাদ পেয়েই টেলিগ্রাম করেছিলাম। আমার ধারণা হয়েছিলো রানীমা মানস যাওয়ার আগে আপনাকে একবার দেখতে চান। আপনিও তো ঠিক এসেই পড়েছিলেন, কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকম হলো। এ যেন মহাপ্রস্থান। কয়েক বছর থেকেই হিমালয়ের এদিক ওদিক ঘুরছিলেন। বছরে দু-একবার করে আলমোড়ায় নামতেন। কিন্তু এখন অন্যরকম মনে হচ্ছে।
রাজচন্দ্র বলেছিলো, আপনি আলমোড়ায় ফিরে যান, আপনার প্রাইভেট স্কুলের ছাত্ররা আছে, রোগীরা আছে। শেঠানীকে অনুরোধ করুন যাতে আমি দুটো ভালো ঘোড়া ও একজন গাইড পাই। যা টাকা লাগে দেবো।