হৈমী বললো–এই যে কুমার, জার্নিস এন্ড?
কুমারনারায়ণ হেসে বললো–আপনাদের কর্মচারীর ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম, অসংখ্য ধন্যবাদ।
নট অ্যাট অল। এখন কোথায় যাবে মনস্থ করেছো? তোমার গাড়ি এসেছে?
কুমার জানালো-সে মরেলগঞ্জে যাবে, তার গাড়ি আসার কোনো কথা নেই।
-মরেলগঞ্জ। সেখানে? সেখানে অন্ধকারে কী করে যাবে? আগে কখনো গিয়েছে?
কুমার বললো–অন্ধকার দেখে এখন আশঙ্কা বটে। পথপ্রদর্শক–অন্তত একটা হারিকেন পেলেও হতো।
-তা তোমাকে দেওয়া যায়, হৈমী হাসলো, কিন্তু এমন সোফিস্টিকেটেড মানুষ, সেই অজপাড়াগাঁয়ে এত রাতে কোথায় যাবে?
-মরেলগঞ্জে আমার মামার বাড়ি।
-তাহলে তোক ঠিক করে দেবো? আমি অবশ্য মরেলগঞ্জের কাউকে চিনি না। শুনছো, এই যুবক মরেলগঞ্জে যেতে চাইছে।
সার রাজচন্দ্র ছিলো। সে হৈমীর কথা শুনে আপাদমস্তক ইউরোপীয় পোশাক-পরা কুমারকে দেখে নিলো, সে তত গাড়িতে অনেকক্ষণ ধরেই তার ইউরোপীয় ম্যানার্স লক্ষ্যও করেছে, সে অন্যমনস্কর মতোই বললো, কিন্তু নীলকুঠি তো বছর বিশেক আগে থেকেই উঠে গিয়েছে। সেখানে একমাত্র তাদেরই বাসযোগ্য বাংলো ছিলো। হ্যাঁ, বিশ বছর তো হলোই। খোঁড়া ডানকান ফিরেছিলো বটে, কিন্তু তারপর তারা সকলেই তো আমাদের চা বাগানে। তারা তখনই বুঝেছিলো নীলের চাইতে চায়ে লাভ বেশি। বাংলো-টাংলোও সম্পত্তিসমেত মহারাজার কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলো। বোধ হয় বছর দশেক আগে একটি ট্যাস মেয়ে থাকতো বটে সেই ভাঙাচোরা বাংলোয়।
সার রাজচন্দ্র কর্তব্য শেষ করে শিস দেওয়ার জন্য ঠোঁট গোল করলো। বোঝা যাচ্ছে, নিজের বাড়িতে ফিরে বেশ সুখী।
হৈমীকুমারকে এবার বেশ বিব্রত দেখতে পেলো। বললো–তাহলে? কাল দিনের বেলা বরং মামাকে খুঁজো। আজ বরং আমাদের কাছে থাকবে? এখানে সম্ভবত ওয়েটিংরুম হয়নি এখনো ।
-কিন্তু এমনিই তো আপনাদের অনেক গেস্ট শুনলাম।
হৈমী বললো–শুনছো, এই ছেলেটি বলছে তোমার অনেক গেস্ট সেজন্য তাকে রাত করে মরেলগঞ্জ যেতে হচ্ছে।
রাজচন্দ্র সবার উপর দিয়ে সেই লালমুখোদের গতিবিধির উপর লক্ষ্য রাখছিলো, বললো–সিলি! গলা তুলে একটু উঁচু করে বললো, ও, বিলি, আইম্ ওয়েটিং।
বিলি সম্ভবত ছোটোলাটের সেক্রেটারি, কাঁধে হাতে ভঙ্গি করে বললো–দিজ রেলওয়ে মে!
সুতরাং অন্যান্য গেস্টরা দু-তিনটে হ্যাঁমে ভাগ করে উঠলে, জোড়া ঘোড়ার ল্যাভোটাতে হৈমী ও সার রাজচন্দ্রের সঙ্গে কুমারকে উঠতে হলো।
.
সাতজন গেস্ট তো ছিলোই; টেলিগ্রাম পেয়ে অল্প সময়ে ভৃত্যরা একতলার সাতটা শোবার ঘর প্রস্তুত রেখেছিলো। দোতলায় ওঠার স্টেয়ারকেসের বাঁ দিকে আরো দু-তিনখানা ঘর। পুরো শীতটা সেগুলো তালাবন্ধ ছিলোলন পার হয়ে গাড়িবারান্দার দুপাশের ঘরগুলোতে দিস ইয়োর্স বলে এক-একজন গেস্টকে দেখিয়ে দিয়ে এবং ড্রিংকস্ পাঠাচ্ছি, কিন্তু বোধ হয় আধঘণ্টায় ডিনার গং বলে সিঁড়ির গোড়ায় তখন সার রাজচন্দ্র এবং হৈমী। তখন কুমারনারায়ণ তাদের পিছনে। তাকে দেখে ভৃত্যরা একটু মুশকিলে পড়লো। বন্ধ ঘরের তালা খুলবে কিনা এই দ্বিধা করতে লাগলো। তখন রাজচন্দ্র বললো––ও ঘর তো ঠাণ্ডা হবে, তুমি বরং ওপরে এসো, মিস্টার কুমারনারায়ণ।
দোতলায় রাজচন্দ্র বললো–তুমি এই ড্রয়িংরুমে আপাতত বসো। এটার সঙ্গে বাথ আছে। এখানে তুমি তৈরী হয়ে নাও। ইনফরম্যাল ডিনার, পোশাক না-পাল্টালেও চলবে। আমি তোমার শোবার ঘর ঠিক করে দেবো। তোমার ড্রিংকস্?
কুমার শুধু চা বললে, রাজচন্দ্র বললো–বেশ, বেশ, হৈমী এসে ততক্ষণ গল্প করবে। আমি একটু গেস্টদের ড্রিংকসের ব্যবস্থা দেখে আসছি।
সুতরাং কিছু রিফ্রেশড় হয়ে কুমার বসতে না বসতেই ভৃত্য তার চা নিয়ে এলো এবং কিছুপরেই হৈমীরও হাসিমুখ দেখা দিলো। ইতিমধ্যে সে আবার পোশাক পালটেছে। শাড়ি তেমন সাদাই বটে, মুক্তোর বদলে কানে হাতে গলায় লোখরাজ। গল্পটা কোনদিকে গড়ায়, সূচনায় যাই থাক, তা সম্ভবত যে গল্প করছে তার মনের নিকটতর বিষয়গুলোর দিকে গড়িয়ে যায়। সুতরাং কুমার যখন সেই ড্রয়িংরুমের কোণে রাখা পাহাড়ে চলা লাঠির দিকে লক্ষ্য করে বললো, আপনারা দুজনেই পাহাড়ে গিয়েছিলেন? অনেক দূর উঠেছিলেন নাকি? হৈমী এক কথায় হাঁ-নানা বলে বললো, এই তত দিন সাতেক আগে পাহাড় থেকে নামা হলো। আমি অবশ্য আলমোড়ার চাইতে বেশি ওপরে উঠিনি। সার রাজচন্দ্র অনেক দূরই গিয়েছিলেন। তুমি কি ওদিকের পাহাড়ে কখনো গিয়েছো? সার রাজচন্দ্ররও এবার এই প্রথম। কিন্তু আসকোট, বালুয়াকোট, সাংখোলা, গারবিয়ং, লিপুধুরা পর্যন্ত এবার গিয়েছিলেন।
কুমার বললো–এসব তো বিখ্যাত জায়গা নয়। তাহলে জানতাম বোধ হয়। আমি আলমোড়ার এক প্রাইভেট স্কুলে কিছুদিন পড়েছি। আলমোড়াই সবচাইতে বড় জায়গা ওদিকে, কিন্তু সেটাও তো বন, আর পাহাড়, চীর বন, আর বড়জোর ঝর্না।
হৈমী বললো–না, বড়ো জায়গা নয়। আসলে সার রাজচন্দ্র একজনকে সি-অফ করতে গিয়েছিলেন। হৈমী একটু ভাবলো, সার রাজচন্দ্র ফিরে এসে যে পথের কষ্টের কথা বলেছে, অনেক জায়গাতেই যে বরফ ছিলো, আবহাওয়ার তাপমান যে হিমাঙ্কের নিচে, সব পথটাই প্রাণ হাতে করে চলা, তা তার অনুভূতিতে ফিরলো। বললো, হ্যাঁ, এটা সার রাজচন্দ্রর খুবই দৃঢ়তা আর সহনশীলতার পরিচয়। তুমি নিশ্চয় মানস-সরোবরের নাম শুনেছো।