শেষ করা যায় না। সকলেই জেনেছিলো, হৈমীর তত বেশি জানার কথাই। গুণাঢ্য মহাশয় সপরিবারে সবান্ধবে তখন রাজনগরে। একটা গোলমাল চলেছিলো বটে। তা কিন্তু বিবাহ হবে না এমন কথা নয়। রানী নাকি বিবাহের আগের বিকেলে আবদার তুলেছিলেন শালগ্রামশিলা সাক্ষী রাখা হোক, মন্ত্রগুলো সংস্কৃতে পাঠ করা হোক, আমার একইমাত্র ছেলে। এটা কি তাৎক্ষণিক আবেগ? অথবা অনেকদিনের পরিকল্পনা? ব্রাহ্ম মেয়েকে পুত্রবধূ করছি অথচ বিবাহটা হবে হিন্দুমতে? গুণাঢ্য মহাশয়ের সঙ্গে তার পরিবার ছাড়াও সমাজের অনেক প্রধান স্থানীয় ব্যক্তি। তারা বলে পাঠালেন, এমন অপমানজনক প্রস্তাবে রাজী হওয়ার চাইতে তাঁরা বরং কন্যাকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। তখন রানীর সেটা আর অনুরোধে রইলো না। সন্ধ্যার কিছু পরে গুণাঢ্য আর তার কন্যাকে তাদের আপত্তি সত্ত্বেও রাজবাড়িতে এনে রাখা হয়েছে। অবশিষ্ট কন্যাত্রী তখন? আমোদ-আহ্লাদ, খাওয়া-দাওয়া, বিভুগুণগান সব চলতে পারে, বিবাহ-কর্ম সমাধা না-হওয়া পর্যন্ত কেউ সেই বাড়ির বাইরে যাবে না। রানীমার হুকুম। অন্তত ত্রিশজন বরকন্দাজ যেন তাদের সম্মানের জন্য বাড়িটাকে চারদিক ঘিরে পাহারা দিচ্ছিলো।
কিন্তু রানীর সেটা পরাজয়ের দিন ছিলো। পরাজয়কে জয়ে পরিণত করার কৌশলগুলো কি একটাও খাটলো? কবিরাজ রাজচন্দ্রকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছিলো। সন্ধ্যার কিছু আগে রাজচন্দ্র ঘুম থেকে উঠেছিলো। ইতিমধ্যে দাসীরাও হৈমীকে ঘুম থেকে তুলে বলেছিলো, রানী বলেছেন রাজকুমারকে স্নান করিয়ে সাজিয়ে দিতে। হৈমী এসে দেখেছিলো, রাজকুমার তার রাইডিং কোট পরছে। আর তখন রানী দ্বিতীয়বার এসেছিলেন রাজচন্দ্রর শোবার ঘরে। কথা কি আর বেশি হলো? দুজন তো দুজনকে চেনেনই।
রানীকে তখন বরং শান্ত দেখাচ্ছিলো। তার ঠোঁট কাপছিলো মনে হলেও, কথাগুলি নিচু স্বরের হলেও, তা সব খুব স্পষ্ট ছিলো। তিনি বললেন, তুমি কি বাইরে যাচ্ছো, পিয়েত্রোর বাংলোয় ফিরে যাচ্ছো?
-হ্যাঁ, মা। সেটাই ভালো লাগবে মনে হচ্ছে।
রানী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বললেন–তোমার বিবাহের ব্যাপারে ইতিমধ্যে আমি কেলেঙ্কারি করেছি।
–বিবাহ আমি করছি না।
–এইসব মানুষেরা অপমানিত হয়ে ফিরে যাবে? সেই নির্দোষ কন্যাটির কথাও ভাবো।
–আমি নিরুপায়। কিছু টাকা দিয়ে দাও।
রানী গলাটাকে আরো নামালেন–শোনো, রাজু, তোমাদের সম্পত্তির চার আনা অংশ আমার, তা জানো? আমি আজ সেই চার আনা অংশ আমার ভাবী পুত্রবধূর নামে লিখে দিয়েছি। গুণাঢ্যমশায় নিজে তার একজন সাক্ষী। আমি সে দস্তখত ফেরত নিতে পারবো না। তার অর্থ কী হয় জানো?
রাজু বললো–ওটাই তো যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ হয়েছে।
–এটা হাসির কথা নয়, রাজু। মুকুন্দ এখন সাবালক, তাকেও তার ছ আনা দিয়ে দিতে হবে। তোমার তাহলে কী রইলো?
রাজু বললো–আমাকে কি তোমার পা ছুঁয়ে বলতে হবে বাকি ছ আনাতেও আমার লোভ নেই?
রানী অদ্ভুতভাবে হাসলেন। বললেন–যেন রসিকতাই, অবশ্য তোমার ফরাসডাঙা থাকে।
বিবাহ হয়েছিলো, আর তা গুণাঢ্যর সমাজকে খুশি করেই, ব্রাহ্মমতে। গুণাঢ্যকে ধাক্কাটা সামলে নিতে সময় দিয়ে সকন্যা তাকে কন্যা-নিবাসে ফেরত পাঠিয়েছিলেন রানী। কায়েত কুমার মুকুন্দ তো এই উৎসবের জন্যই ফারলো নিয়ে চীন থেকে এসেছিলো, আর মায়ের সঙ্গে রাজবাড়িতেই উপস্থিত ছিলো। সেই রাত্রিতেই গুণাঢ্যর কন্যার সঙ্গে বিবাহ হয়েছিলো তার। ঘুমের ঘোরে কন্যা কি টের পেয়েছিলো যে বর বদলে গেলো?
সে দিনই জানা গিয়েছিলো, কায়েত বাড়ির কুমারও এ বাড়িরই রাজকুমার, বরং সেই জ্যেষ্ঠ এবং তার নামটা অত বড়-মুকুন্দবিলাসস্মৃতি।
অবশ্য বলা যায়, হৈমী সার রাজচন্দ্রকে একবার দেখে নিলো, সম্পত্তির ছ-আনা অংশের সঙ্গে ফরাসডাঙা আর নানা শেয়ার ও স্টক যোগ হলে কম হয় না, যদিও রাজনগরের রাজবাড়িটাও রানীমার চারআনি অংশের মধ্যে পড়ে বলে তা হাতছাড়া হয়; আর তখনকার দিনে গুণাঢ্যর সহায়তা না পেলে ফরাসডাঙাকে নিয়ে অত কেলেঙ্কারির পরে কারো আর রাজা উপাধি পাওয়া সম্ভব ছিলো না।
.
০২.
সেই রাত্রির সেই ব্যাপারে মৃত রাজার সম্পত্তির ট্রাস্টি হিসাবে রানী একটা দীর্ঘদিনের ভুলকে শুধরে নিলেন কিনা বলা যায় না। কিন্তু গাড়িটা থামলো। যেমন ছিলো তেমন অবস্থাতেই সার রাজচন্দ্র প্রথমে, পরে হৈমী নামলো গাড়ি থেকে। ভৃত্যরা, কর্মচারীরা তো প্রস্তুত ছিলোই। তারা মালপত্র গুছিয়ে নিতে গাড়িতে উঠলো। কুমারনারায়ণেরই বরং তাদের ভিড় এড়িয়ে নামতে অসুবিধা হলো। ততক্ষণে পাশাপাশি আর সব কামরা থেকে কুমারনারায়ণের সেই লালমুখোরা নামছে। সার রাজচন্দ্র একজন কর্মচারীকে তাদের দেখিয়ে দিলো। তারা অবশ্যই শুধু লালমুখোনয়। রেলের বড়ো অফিসার, জেলার কালেক্টর, ছোটোলাটের প্রাইভেট সেক্রেটারি ইত্যাদি।
তারা সকলেই কর্মচারীদের যার যার মালপত্র দেখিয়ে দিতে ব্যস্ত, তাছাড়া তার পরেও তো তাদের স্টেশন পরিদর্শন নামে কর্তব্য আছে। নতুন স্টেশনে সেই সন্ধ্যাতেই তো প্রথম। গাড়ি এসেছে। স্টেশনটাকেও সেজন্যই সুসজ্জিত করা।
তারা সকলেই আবার সে রাত্রির জন্য রাজচন্দ্রর গেস্ট। রাজচন্দ্র এবং হৈমী স্টেশনের টিকেট-গেটের পাশে আলোর নিচে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। কুমারনারায়ণ তার সুটকেসটাকে টানতে টানতে, স্টেশনের আলো আর সেই আলোর বাইরে অন্ধকার, যাকে সূচীভেদ্য বলা যায়, দেখতে দেখতে গেটের কাছেই এসে পৌঁছলো। হৈমী তাকে আগে দেখতে পেলো। সে নিজে তো অন্ধকার দেখেই চিন্তাকুল।