পোর্টের বোকেটা বিশেষ ভালো। কামরাটা ভরে উঠেছে গন্ধে। সার রাজচন্দ্র সিগার ধরালো। টান দিয়ে কাশতে শুরু করলে মহিলা বললো–পাহাড় থেকে নামা সাত দিন হয়ে গেলো। কাশিটা রয়ে গেলো। কিছুতে শুনলে না ডাক্তার দেখানোর কথা, কলকাতায় থেকেও
সার রাজচন্দ্র কথাটাকে কিংবা মুখের সামনের ধোঁয়াটাকে মৃদু হাত নেড়ে সরিয়ে দিলো। তার আঙুলগুলো লম্বা, শরীরের গড়নের তুলনায় বরং সরু আর হালকা। সে হেসে বললো, তার চাইতে মজার কথাটা ভাবো হৈমী, রানীমারই লোকসান হয়েছিলো। তার বান্দা আর গজা গিয়েছিলো; ওদের তো একটা পাইক।
হৈমী বললো, মনোহর সিং-এর ব্যাপারটা?
–সেটা একটা ভড় ছিলো না?
সার রাজচন্দ্র, ধোঁয়া লাগলে যেমন, চোখ দুটোকে স্তিমিত করে একটু ভাবলো।
হৈমী বললো, মশাল নাকি?
রাজচন্দ্র কাঁচের উপরে পিছলে যাওয়া ধোঁয়াটে লাল আলোটাকে দেখে নিয়ে বললো, লাইন ক্লিয়ারেন্স। তাহলে তোমার তারাবাড়ি আর এক ফারলং। সে সিগারেটকে কামরার অ্যাশট্রেতে রেখে নিজের ওয়াইন-কাপটা আবার ভরে নিলো, হৈমীর ওয়াইন কাপটাতেও ঢেলে দিলো প্রায় পুরো কাপ।
কুমারনারায়ণ নামে সেই তরুণের একটা বিচিত্র অনুভূতি হলো। এক ফারলং যেতে কতটুকুই বা সময়, কিন্তু দ্যাখো, নামার আগে যে গোছগাছ করা হয় তার কোনো চেষ্টা নেই। বাম্পারটার ডালা খোলা হয়েছিলো, তেমন ভোলা। এদিকে-ওদিকে অনেক মালপত্র ছড়ানো। দু-দুটো রাইফেল, পাহাড়ে বেড়ানোর দু-একটা লাঠি, শহরে বেড়ানোর লাঠি, শাল, কোট, রাগ, এখানে-ওখানে রাখা; তাছাড়া স্তুপাকার ট্রাঙ্ক, সুটকেস। সে মনে মনে হেসে ভাবলো, ওয়াইন-কাপ হাতেই নামবে? হয়তো বোতলটা, ক্লাসগুলোও ছড়ানো থাকবে কামরায়। হয়তো ভৃত্যরা এসে গুছিয়ে নামাবে সবকিছু।
.
ওয়াইন-কাপটা তুলে ঠোঁটের কাছে এনে হৈমী সলজ্জভাবে হাসলো। এই প্রথম তার মাৰ্বল সাদা গালে কিছু অন্য রং দেখা দিলো। লজ্জা বোধ হলো তার। তার মনে পড়লো, লজ্জায় পড়েছিলো সে। বিশ বছর আগেকার সে লজ্জা অবশ্যই পালাতে বলে না। গল্পের মতো মনে পড়ে।
হ্যাঁ, বেশ লজ্জাই। যা কেউ ভাবতে পারে না তেমন করে নিজের মহল থেকে রাজকুমারের মহল পর্যন্ত সমস্তটা পথ দাসদাসী, আত্মীয়স্বজন, কর্মচারীদের ভীত সন্ত্রস্ত করে রানী নিজে রাজকুমারের শোবার ঘরে এসে দাঁড়ালেন। বলতে বলতে ঢুকলেন, কী আক্কেল তোমার, রাজু? স্নানের সময় হয়। ওরা গন্ধ নিয়ে, কত রকমের জল নিয়ে বসে-কিন্তু কথা শেষ করার আগে রাজকুমারের বিছানার দিকে চোখ পড়েছিলো। বিছানার উপরে রাজকুমার, তার হাতে ওয়াইন-গ্লাসে ভরা হুইস্কি তখন। এক হাত দূরে হৈমী, তার হাতেও তেমন। মনে হয়েছিলো, রানীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেউ রং ঢেলে দিলো। যেন ফিরে যাবেন, দৌড়ে পালাবেন। কিন্তু লোহার মতো শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন, বললেন–হৈমী!
হৈমী উঠে দাঁড়ালো। হুইস্কি চলকে পড়লো, কিন্তু যা সে বুঝতে পারেনি, ততটা হুইস্কি, অনেকবার অল্প অল্প করে হলেও, তার ভিতরে তখন। পা টলে উঠলে সে খাটের থাম ধরে দাঁড়িয়েছিলো।
রানী ছিঃ ছিঃ বলতে গেলেন, কিন্তু দৃঢ়স্বরে বললেন
এটা স্বীকার করতেই হবে, হৈমী ভাবলো, তখন কম বয়সের তুলনাতেও, বোকা ছিলাম। নতুবা কেউ একজন অনুরোধ করতে থাকলেই প্রায় এক দেড় ঘণ্টা ধরে, কারো সঙ্গী হওয়ার জন্যই, একটু একটু করে অতটা হুইস্কি কেন খেয়ে ফেলবো যাতে পা টলে যায়, সবকিছু স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে? রাজকুমার বেএক্তিয়ারই ছিলেন। তা না হলে কেউ কি বলে, যেমন বলছিলেন, এত লোক, বাড়ি-ভরা এত মানুষ, এর মধ্যে কি নয়নতারা নেই? নয়ন আসেনি বলছো? এত উৎসব, এত আয়োজন, তবু নয়নতারা ফেরেনি–এ কি বিশ্বাস করতে বলো? অথচ দুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়ার পর থেকে রাজকুমার একেবারে স্তব্ধ ছিলেন। সেই পাঁচ ছয় মাসে কারো সঙ্গেই কি কথা বলেছেন? রাজবাড়ির সংসার তেমনই চলছিলো যেমন চলে, বরং সেই উৎসবের আয়োজনগুলো ধীরে ধীরে। এটা কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপারই যে রাজবাড়ির বোটটা থেকে কেউ তেমন পড়ে যেতে পারে, শুধু দুই নদী কেমন মিলছে দেখতে গিয়ে! হোক তা ভাদ্রের গঙ্গা। সংবাদ পেয়ে স্বয়ং হরদয়াল গিয়েছিলো তদন্তে, কিন্তু এলাহাবাদের কাছে গঙ্গায় জাল ফেলে কি কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়? রূপচাঁদ তো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জলে লাফিয়ে পড়েছিলো; সেও তলিয়ে গিয়েছিলো মাত্র। কারো কারো জীবন দুর্ঘটনাবহুল হয়।
রানী দৃঢ়স্বরে বললেন–হৈমী, রাজকুমারকে বাথে নিয়ে যাও স্নান করাতে, রূপচাঁদকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। খবরটা যেন বাইরে না যায়। রাজু, আজ তোমার বিবাহের দিন তা জানতে, অথচ
রাজচন্দ্র উঠে দাঁড়ালো। তার মুখ কথা বলার আবেগে লাল হয়ে উঠলো। সে যে দু পায়ের উপরে টলছে তা বোঝা গেলো। কথা তৈরি করার চেষ্টায় ডান হাতে বাড়িয়ে যেন শূন্যে অক্ষর আঁকতে লাগলো। কিন্তু কথা এসেও গেলো-বিয়ে? কার বিয়ে? কী যে বলে তুমি, মা!
হঠাৎ রাজকুমার যেন রানীমাকে এতক্ষণে দেখতে পেলো, নিজের মুখের উপরে হাত রাখলো, বেশ স্পষ্ট করে ভেবে নিলো, বললো–ও, তুমি আমার বিবাহের কথা বলছো? তা সব লোককে বিবাহ করতে হবে কেন? নাঃ, আমি বিবাহ করবো না।
রানীমা কী বুঝলেন কে জানে? ধমক দিতে গেলেন, কিন্তু গলা নামিয়ে বললেন–রাজু, এখন আর তা বলা যায় না। কন্যাপক্ষ উপস্থিত। কন্যার অধিবাস হয়ে গিয়েছে। তার মুখ চেয়েও। কথাটা শেষ হলো না।