তরুণ–সবগুলো ফার্স্টক্লাস রিজার্ভড়। সবগুলোতে লালমুখো বাঁদর।
সার রাজচন্দ্র-হতেই পারে। এটাকে স্পেশাল ট্রেন বলা যায়।
মহিলা-কারো ল্যাজ টানোনি তো?
তারপর এক ঘণ্টার মধ্যে তরুণের নাম কুমারনারায়ণ জেনে তাকে কুমার বলে যাচ্ছে। এই মহিলা। একবার তরুণ বলেছিলো দুটো শব্দ মিলে একটা নাম। মহিলাটি বলেছিলো, আমরা কুমার বলতে অভ্যস্ত। অসুবিধা হচ্ছে না। সার রাজচন্দ্র গাড়ির ভিতরের দিকে মুখ ফেরালে তরুণটি ভাবলো, এই সার লোকটি? চটপটে তো বটেই, যদিও চোখে দেখে অন্য রকম মনে হতে পারে। নৃশংস? নাকি কিছু ভেবে কাজ করে না? এর আগের স্টেশন ছাড়ার কয়েক মিনিট পরেই ট্রেনটাকে চেন টেনে থামিয়ে রাইফেল নিয়ে নেমেছিলো। যে হরিণটাকে ছুটন্ত ট্রেনের সব যাত্রী দু-তিন মিনিট ধরে দেখে অবাক হচ্ছিলো, সেটাকে গুলি করে মারলো। যাই হোক, গাড়িটার সেখানে, সেই মাঠের মধ্যে, আধঘণ্টা দেরি হয়ে গিয়েছে। আর এখন তো ধিকিধিকি চলেছে। নতুন লাইন, মাত্র দুমাস আগে শেষ হয়েছে। এখন ট্রেন এই লাইনের বর্তমান শেষ স্টেশন তারাবাড়ির উদ্দেশ্যে চলেছে।
আর কয়েক মাইল পরেই সেই তারাবাড়ি স্টেশন। এখানে এখনো প্রধান যোগাযোগ তো স্টিমারেই ছিলো। তার স্টেশনের নাম তারাবাড়ি-ঘাট। এখন এই রেল-স্টেশন হওয়ার পরে হয়তো স্টিমার-স্টেশনটার মর্যাদা কমে যাবে। আজ সেই তারাবাড়ি রেল-স্টেশনে, তার নতুন বাড়িতে, নতুন-করা প্ল্যাটফর্মে, যাতে এখানে ওখানে রাখা টবের গাছ, নিশ্চয় এতক্ষণে অনেক আলো জ্বালানো হয়েছে। নতুন স্টেশনমাস্টার তার স্টাফ নিয়ে এই প্রথম ট্রেনের অপেক্ষায় ঘর বার করছে। আমাদের ভাবাই অভ্যাস। এই তারাবাড়ি নাম নিয়ে ভাবাটা অবশ্য কিছু পুরনো, কারণ তারাবাড়ি ঘাট তো বছর পনেরোই হয়েছে। ধর্মের দেশে ধর্মের কথাই আগে মনে আসে। কিন্তু তারাবাড়িতে সার রাজচন্দ্রের প্রকাণ্ড বাড়িটার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে যে একমাত্র মন্দিরটা দেখতে পাও, সেটা বিশেষ সুন্দরই, যদিও রক্ষণাবেক্ষণে কিছু ত্রুটি চোখে পড়ে, সেটা কিন্তু শিবের, আর মন্দির বলতে এখানে ওই একটিই। পুরোহিতকে এরকম বলায় সে নাকি বলেছিলো, তা তারা গৌরী একই তো; গৌরীপাটেই তো তারারও অধিষ্ঠান ধরা যায়। তাছাড়া শিবের অন্তরে কি তারা নেই?
মহিলা বললো–তোমাকে স্যান্ডউইচ দু-একটা?
সার রাজচন্দ্র প্রথমে বললো, না; পরে বললো, একটু পোর্ট দাও।
মহিলা উঠে বেত কাঠ পিতলের সমন্বয়ে তৈরী সুদৃশ্য কাঁপ খুলে প্লেট ইত্যাদি বার করে, একটা প্লেটে একটা স্যান্ডউইচ সার রাজচন্দ্রর বাঙ্কে তার পাশে রাখলো। দুটো ওয়াইন কাপ বার করে আর একটা তেমন প্লেটে রাখলো। একটা গাঢ় ব্রাউন রঙের বোতল বার করে রাখলো তার উপরে। তরুণ নিষেধ করলেও খান-দুয়েক স্যান্ডউইচ তার প্লেটে তুলে দিলো মহিলা। বললো, মাটন ওনলি। সার রাজচন্দ্র বোতল খুললো, নিজের ওয়াইন কাপটাকে পুরো ভরে নিয়ে দ্বিতীয় কাপটাকে আধাআধি ভরে মহিলাকে নাও বলে তুলে দিলো।
একবার মহিলা বললো–এতগুলো গেস্ট নিয়ে চলেছো, অথচ গাড়ি তো যেন শামুক। ডিনার শেষ হতে মাঝরাত না হয়। ঘরগুলোর বা কী ব্যবস্থা হয়েছে, কে জানে!
সার রাজচন্দ্র বললো–তুমি তো তাদের টেলিগ্রাম করেই জানিয়েছে গেস্টের কথা; কেন মিছে উদ্বেগ?
তরুণ কুমারনারায়ণ ভাবলো, সম্বন্ধটা স্বামী-স্ত্রীর মতো মনে হয়; বোধ হয় হিন্দু নয়। সিঁদুর তো নেই-ই, শাড়ি সাদা। আর এখন দ্যাখো। ওয়াইন কাপটা অবলীলায়! সার রাজচন্দ্র তবু তো স্যান্ডউইচ চিবোচ্ছেন, এঁর দ্যাখো, নিছক ওয়াইন।
ট্রেনটা জোরে কটা হুইসিল দিলো, তাহলে তারাবাড়ি নামে সেই নতুন স্টেশনের আলো চোখে পড়েছে। তরুণ জানলার কাঁচ দিয়ে একবার চাইলো। দূরে যে আলোকবিন্দু তা কোথায় কত দূরে কত অন্ধকারের গভীরে বোঝা যায় না। তাহলেও গন্তব্যের আর বেশি দেরি নেই। সে তার লাগেজ বলতে একমাত্র বড়ো সুটকেসটার উপরে চোখ বুলিয়ে নিলো। বোঝাটা বড় নয়, আসল ব্যাপারটা অন্ধকার। ট্রেনটার শিডিউল স্টপ বিকেল পাঁচটায়, এখন সাতটা বাজতে চলেছে। ওই আলোকবিন্দুই প্রমাণ করে তার চারিদিকে কী রকম অন্ধকার হবে গ্রামের পথে। লোককে জিজ্ঞাসা করেই যেতে হবে, হয়তো পথে লোকও থাকবে না। উপরন্তু যে রকম হদিশ পাত্তা নিয়ে সে রওনা হয়েছিলো, এখন ব্যাপারটা তার কিছু অন্য রকম দেখছে। সে শুনেছিলো, মরেলগঞ্জে রেলওয়ে স্টেশন নেই। কিন্তু সেটা রাজনগরের মাইল দুয়েক উত্তরে। নামে যে স্টেশনটা তারা পার হয়ে এসেছে তা নাকি মরেলগঞ্জ থেকে ক্রোশ পাঁচ-ছয় দূরে। আসছে শুনে সে নামার জন্য প্রস্তুত হতে। গেলে মহিলা জিজ্ঞাসা করেছিলো–তুমি রাজনগরে নামবে বলেছিলে না?
-এটাই তো?
মহিলা বলেছিলো–স্টেশনে, না রাজনগরে? এটা নয়, আসলে এটাকে কায়েতবাড়ি বলে। রাজা থাকতেন এখানেই বলে স্টেশনের নাম রাজনগর। আসল তারাবাড়ি নামে নতুন স্টেশনের দিকে, বরং তাকেও ছাড়িয়ে দু ক্রোশ। তোমার তারাবাড়িতে নামা ভালো। তারাবাড়িও আসল নাম নয়। আসল নাম ফরাসডাঙাই এখনো চলে।
তরুণের সম্ভবত রাজা সম্বন্ধে কৌতূহল ছিলো অন্য অনেকের মতো। সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রাজার কথা তুলেছিলো। তখন মহিলা বলেছিলো, রাজার নাম ছিলো মহারাজা কর্নেল সার মুকুন্দবিলাস স্মৃতি খাঁ, কে. সি. বি.। কিন্তু বছর দুয়েক হলো তিনি গত হয়েছেন। মহারানী পুত্রকন্যাদের নিয়ে বিলেতেই থাকেন প্রায়।