ঝড়ে কি শোনা যায়? এই একটু সুবিধা, নয়নতারা তখন দু হাতে জড়িয়ে রাজুর মুখকে নিজের বুকের উপরে তুলে নিতে পেরেছে। রাজুর কান তার ঠোঁটের কাছে। সে বললো–রাজু! রাজু!
রাজুর মন তার শরীরে ফিরলো। সে একবার জিজ্ঞাসা করলো–কে? নয়ন? নয়নতারা? কিন্তু সে-মনটা যেন অন্য কারোও। যেন ঘুমের ঘোরে সে-মন।
নয়নতারা বললো–বা, ওঠো। চলো, আমরা চলে যাই।
রাজচন্দ্র হঠাৎ সম্বিত পেয়ে উঠে বসে বললো–আরে ছি ছি, নয়নতারা, এই ঝড়ে এভাবে বার হতে হয়?
নয়নতারা চোখ মুদলো না, দু হাতের বাঁধন একটু আলগা করে দিলো, নিজের অজ্ঞাতসারে নিজেরই ঠোঁট দুটিকে রাজুর কপালে ছোঁয়ালো।
দুএক পা চলে রাজচন্দ্র বললো–ওমা, এ কী?
নয়নতারা বললো–ওভাবে তাকিয়ো না, দেখো না কোথায় খসে পড়েছে। ঠাট্টা কোরো না।
রাজচন্দ্র হাসলো-চাইবো কেন? অনুভবে ধরা পড়ে।
তখন বাতাস কমেছে। বাঁকা বৃষ্টির ফলায় শীত লাগিয়ে দিচ্ছে। নয়নতারার পা ঠিকমতো পড়তে চাইছেনা। রাজচন্দ্র বললো–একেবারে অন্ধকার না-হলে বাংলোয় ফিরবে কী করে?
গাঢ় অন্ধকার হলে তারা বাংলায় ফিরে থাকবে।
তখন রাত হয়েছে। বললো–আলোটা? থাকবে?
শেজের আলোতে সে ঘরের চারিদিকে চাইলো, যেন ঘরটা তার পরিচিত হওয়াতেই ভালো লাগছেনা। বলে–চলে যাবো, চলো। এখানে আসা তো সেই ফরাসডাঙাতে ফেরাই।
কিন্তু নয়নতারা শয্যায় এলো। বললো–বা, আমাকে বুঝি দেখবে না?
শেজের আলোয় নয়নতারা ঝিকমিক করে হাসলো।
১৭. ১৮৮৩ খৃস্টাব্দের শীতকাল
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
০১.
সেটা ১৮৮৩ খৃস্টাব্দের শীতকাল। আবার প্রশ্ন উঠবে, শীত তো খ্রিস্টবর্ষের প্রথমেও থাকে, শেষেও; অর্থাৎ তখন নভেম্বর-ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি? আমার ধারণা নভেম্বর-ডিসেম্বর সময়টাই যুক্তিযুক্ত হবে। শীতকালে প্রকৃতিতে সবুজ কমে,বাদামী, হলুদ, সোনালি বাড়ে। এতক্ষণ তো রেলপথের দু পারেই মাঠগুলোতে, কৃষকদের বাড়িগুলোতে অনেক গাছের পাতায় সেই বাদামী, হলুদ, লাল এবং সোনালি। তখন গাড়িটা বেশ দ্রুত গতিতে চলেছিলো, কিন্তু দিনের আলো ছিলো; এখন ধীরে চললেও দিনের আলোও তো কমে আসছে। ফলে তখন জানলার বাইরে রোদ-মাখানো দৃশ্যগুলোই আকর্ষণ করছিলো। তখন রেল রোড এত নতুন যে কামরার জানলায় এরকম দৃশ্য-পরিবর্তন বিশেষ আনন্দজনক। কারো কাছেই একঘেয়ে লাগার মতো হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এখন সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে কামরার ভিতরে আনতে হয়। বাতাসটাও ঠাণ্ডা। সার রাজচন্দ্র পরপর দুটো জানলার শার্সি ফেলে দিয়ে কামরার ভিতরের দিকে দৃষ্টি দিলো। প্রথম শ্রেণীর কামরা। এখন যেমন তখনো তেমন কিছুটা বৈশিষ্ট্য তো ছিলোই অন্য শ্রেণী থেকে। এই কামরাটার আর একটু বৈশিষ্ট্য বলে নেওয়া যায়। লোহালক্কড়, রিবেট, ক্রু সব সোনালি রঙের পিতলের হবে, সিলিং-এর আলোটা তো পিতলেরই, আর বসবার গদিগুলো প্রকৃতপক্ষে উজ্জ্বল পালিশদার চামড়ার। এটা বলা সম্ভব নয়, এই গাড়িটাতে এরকম কামরা বরাবর থাকতো কিনা। সেদিন ছিলো, কয়েকখানাই ছিলো। বরং সাধারণের জন্য কামরাই কম। এই কামরায় আপাতত তিনজন যাত্রী। সার রাজচন্দ্র নামে এই দশাসই পুরুষ। তার পায়ের ভারি পুরু সোলের বিলিতি জুতো ওস্টেড ট্রাউজার্স ও জুতার মধ্যে দৃশ্যমান খয়েরিতে সাদার ফুল তোলা উলের মোজা, গায়ের চেক টুইড কোট থেকে বোঝা যায়, তার চল্লিশোর্ধ্ব শরীরটা এখন বেশ ভারি, যদিও মজবুত। মাথার পিছন দিকের চুলগুলো ঈষৎ লাল। কলপ? মুখটায় একটা লালচে ভাব আছে যাকে সানট্যান বলা যায়। তার উপরে বেশ বড়ো মাপের খয়েরি বাদামি গোঁফ। দুটো বাঙ্ক। এপারের বাঙ্কে সার রাজচন্দ্র। ওপারেরটিতে দুজন। একজন মহিলা, অন্যজন পুরুষ। মহিলাটির পরনে দুধ-গরদ, কিন্তু পাড় নেই। সাদা কারো কারো পছন্দের হয়। সেজন্য গলায় এক লহরের একটা মুক্তার হার, হাতে দুগাছা মুক্তার বালা।
স্নানের সুবিধা কোথায়? তাহলেও কিছুক্ষণ আগে, বিকেলের অভ্যাস অনুসারেই, পাশের ক্লোজেটে গিয়ে শাড়ি পালটে ফিরেছে। এক দুধ-গরদ থেকে অন্য দুধ-গরদ, তখনই চুলগুলো ব্রাশে উজ্জ্বল করে পিঠে ছড়ানো হয়েছে। ফলে মাথা ঝাঁকালে মৃদু সৌরভ উঠছে। সেই বাঙ্কের পুরুষযাত্রীটি বয়সে তরুণ। তাকে এরকম বললে বা তার বয়স একুশ-বাইশ বললেই তারুণ্যটাকে বোঝা যায় না। কারো কারো চোখে মুখেও বিষয়টা সুখের আকারে জড়ানো থাকে। মনে হয় যেন পৃথিবীর চূড়ায় বসে। খুবই গৌরবর্ণ রং। চুলগুলো কালো এবং কপাল-ঢাকা অবাধ্য। চোখ দুটো ডাগর, চঞ্চলা কোনো মেয়ের যেন। ঠোঁট লাল, তার উপরে সরু গোঁফের রেখা। কারো কারো এসব পুরুষালি চিহ্ন পরে প্রকাশ পায়। এই তরুণটিকে এখন কিছুটা সলজ্জ দেখাচ্ছে, আর তা বেড়েছে সার রাজচন্দ্র শার্সি নামিয়ে কামরার ভিতরে চোখ রাখাতে। কারণ তরুণটির ট্রাউজার্সের হাঁটুর উপরে একটা সুদৃশ্য তোয়ালে, তার উপরে অনেক রকমের অনেক মিষ্টিযুক্ত রূপার একটি থালা। তরুণটি বুঝতে পারছে না মহিলাটিতে ঝাজ কিংবা মিষ্টি বেশি। মিষ্টি সাজিয়ে দিয়ে হাতের উপরে থালা রেখে বলেছিলো, হাত দিয়েই খাও, লজ্জা কী? প্রায় একশো মাইল দক্ষিণে একটা স্টেশনে সে তার সুটকেসটা হাতে গাড়ির কামরায় কামরায় ঢু মেরে বেড়াচ্ছিলো। এই কামরার হাতলে হাত দিয়ে এটাকেও রিজার্ভড় দেখে সে ফিরে যাচ্ছিলো। এই সময়ে মহিলাটির সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়েছিলো। মহিলা বলেছিলো, কোথায় যাওয়া হবে? তরুণের গন্তব্য শুনে বলেছিলো, আসুন। আমরাও তাই। তরুণ উঠে এসে ইংরেজিতে ধন্যবাদ দিলে মহিলাটিও যথোপযুক্ত উত্তর দিয়েছিলো সেই ভাষাতেই। কিন্তু সেই অত্যন্ত রাজকীয় মহিলার আর একটি দিক টিজ করা, খোঁচানো, খেপানো। প্রথম পাঁচ মিনিটেই এইরকম কথা হয়েছিলো।