সেদিন দুপুরের পরপরই হঠাৎ নদীর দিক থেকে কয়েকটা ধুলোর ঝাপটা এলো। কিছুক্ষণ বাদে সেদিকের আকাশে খানিকটা কালো মেঘ দেখা দিলো। সেই কালো মেঘের মধ্যে দিয়ে কয়েকটা পাখি উড়ে গেলো। খানিকটা বাদে যেন বাতাস একদম বন্ধ। একদল কাক তাড়াতাড়ি ডেকে উড়ে পালালো। মিনিট দশেক গেলো না বিকেলের আকাশে সন্ধ্যা নেমে গেলো যেন। এমন যে নদীর উপরের আকাশটা বিদ্যুতে চিরছে মনে হলো।
রাঁধুনি আর ভৃত্য জানলা দিয়ে দেখছিলো। ভৃত্য বললো, আলো জ্বালাতে হবে।
ভৃত্য ঘরে ঘরে আলো জ্বালতে চলে গেলো।
রাঁধুনি দেখলো রাজকুমার বাংলোর বারান্দায় এলো। খানিকটা সময় সেখানে দাঁড়িয়ে রাজকুমার বারান্দা থেকে মাঠে নামলো। মাঠে থেকে থেকে একটা বাদামী রং পড়ছে, যেন উপর থেকে। রাজকুমার মাঠে ঘুরে ঘুরে অবশেষে মন্দিরের সেই উঁচু চত্বর, যা প্রকৃতপক্ষে ফরাসী পিয়েত্রোর হাওয়া ঘরের ভিত, তার উপর গিয়ে দাঁড়ালো। হাঁটতে হাঁটতে একেবারে চত্বরের কিনারে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। দূর থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু দাঁড়ানোর ভঙ্গি থেকে বোঝা যায় যেন কৌতুকে আর কৌতূহলে কিছু দেখছে।
আর এক ঝাঁক পাখি খুব ব্যস্তসমস্ত হয়ে উড়ে গেল। মাঠের উপরের বাদামী রংটা ছাই-এর রং নিলো এবার।
এই দ্যাখো, নিজের মনে মন্তব্য করলো রাঁধুনি, রাজকুমার চত্বর থেকে নেমে ডানদিকে চলেছে! ওটা কি হাতিশুড়ো যা নিচে থেকে বাঁধ ছাড়িয়ে উঠলো এবার? রাজকুমার কিন্তু সেটাকে আমল দিলো না। দাঁড়িয়ে পড়ে শূন্যে দুহাত তুলছে। এত দূর থেকে বোঝা যায় না কিন্তু আকাশে কি কিছু আছে, যার দিকে হাত তুলছে?
রাঁধুনি বারান্দায় এলো। সে দেখলো ডানদিকে বাঁধের উপরে একটা অদ্ভুত চেহারার কালো মেঘের টুকরো। সেটাই যেন রাজকুমারের লক্ষ্যে। কালো আর সাদায় মিশিয়ে তৈরী সেই মেঘ। তার জন্যই যেন হাত দুটো আকাশের দিকে তোলা।
এ তো ঝড়, এ তো ঝড়, এই বললো– রাঁধুনি। মাটির উপরে সর সর খর খর করে, দরজা-জানালার ঝাপটা শব্দ দিয়ে, বাতাসটা বারান্দাতে ধাক্কা মারলো। নদীর ধারে-কাছে বাতাসে বালি থাকবেই। নাকি সেই হাতিশুড়োটা ভেঙে পড়লো? গাছপালা নেই, এত শোঁ শোঁ শব্দ কিসের?
কিন্তু এ কী কাণ্ড! রাজকুমারকে দেখা যায়, যায়ও না। দ্যাখো, ঝড় উঠে এসেছে, ঝড়। পাক খাচ্ছে। অন্ধকার হয়ে গেলো। রাজকুমার সেই মেঘের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে মুখটা এখনো উঁচুদিকে। হঠাৎ ভয় হলো রাঁধুনির, যেভাবে চলেছেন বাঁধের ধার থেকে নিচে পড়ে যান যদি!
রাঁধুনি বারান্দা থেকে নেমে নিজেকে বললো, দাঁড়ানো যায় না দেখি। কিছু যেন তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে উঠলো। সে কি ডাকবে রাজকুমারকে? এই শব্দে তা কি শোনা যাবে?
দাঁড়ানোই যায় না। চাদর খুলে গিয়ে পতাকার মতো উড়ছে। তার প্রান্তটাকে গুটিয়ে আনাও কঠিন, তা করতে গেলে পায়ের পাতার ওপরের শাড়ি হাঁটুর কাছে উঠে পাক খাচ্ছে। কিন্তু রাজকুমার? পড়ে গেলেন নাকি?
রাঁধুনি ডাকলো, রাজকুমার! ডাকটা এক হাত দূরে গেলো কিনা সন্দেহ। রাঁধুনি ছুটতে ছুটতে ডাকলো, রাজু! তার পায়ের মলের শব্দ দূরের কথা, তার ফোঁপানোর শব্দও শোনা গেল না।
নয়নতারা ছুটতে-ছুটতে ঘাটের মাথায় এসে দেখলো, দেখাই কি যায় চোখ মেলে, নিচে যেন তোলপাড় চলেছে, যেন বাঁধের কোলে নদীর খাত একটা প্রকাণ্ড মন্থন-ভড়। ধুলোর বাতাস ঘূর্ণি তুলে পাক খাচ্ছে। সে কি নামতে পারে? রাজকুমার হাত ধরে ধরে নামিয়েছিলো তাকে এই ভাঙাঘাটে। চুল এলো হয়েছিলো, হাত তুলে চুল জড়ো করতে গিয়ে চাদরটা গা থেকে উড়ে সিঁড়িগুলোর পাশ দিয়ে নিচে পড়ে অদৃশ্য হলো। কিন্তু রাজকুমার? তাকে তো দেখাই যাচ্ছে না!নয়নতারা চিৎকার করে ডাকলো, রাজুজু! ডাকটা বাতাসের শব্দে ডুবে গেলো না শুধু, যেন তার চাপে ফিরে এসে তার মুখে জড়িয়ে গেলো কান্নার মতো হয়ে। ঘাটের ধাপ বেয়ে নামতে নামতে, সে তো হাতে পায়েই চলা, শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে গেলো নিজের পায়ে জড়িয়ে।
শেষ ধাপটা সে লাফিয়ে নামলো। কিন্তু রাজকুমার কোথায়? লাফিয়ে নামতে গিয়ে সে হামা দিয়ে পড়েছিলো। এ কী, জলও যে এখানে! এ কি বাতাসের তাড়ায় নদীর জলের উপরে উঠে আসা? উঠতে গিয়ে কাঁধের শাড়ি কোমরে নেমে পৎ-পৎ শোঁ-শোঁ করে উড়ছে। তা সত্ত্বেও সেই শব্দকে–সব শব্দকে ডুবিয়ে নয়নতারা হাহাকার করে উঠলো, রাজু, আমার রাজু।
ঝড়ের গতির বিরুদ্ধে, প্রবাদ আছে, এই গঙ্গার বুকে যখন সেই ঝড়, হাজার পাঁচ হাজার মুণি হলেও, পাল নামিয়ে না দিলে পাল ছিঁড়ে রসাতলে যায় নৌকো। মাস্তুলসমেত পাল উড়ে যায়। বাতাসের ঝাপটায় নৌকোকে চরে তুলে দেয়। ধুলোর ঝাপটায় আলোর চোখ অন্ধ করে। নয়নতারার পক্ষে শাড়ি ধরে রাখাই কি সম্ভব! শেষবার বালিয়াড়িটার মাথায় উঠতে গেলে তা কোমর থেকে নেমে একপাকে হাঁটুর কাছ জড়িয়ে ছিলো। কে আর দেখছে সেসব দিকে? সে তো বালির উপরে কপাল চাপড়ে, আমার রাজু বলে কঁদছে তখন।
আর তখন আকাশ থেকে তেরচা ধারে জলও নামছে। পায়ের তলে তখন মাঝে মাঝে অগভীর জল। বালিয়াড়িটার, তার মাথাও তো তখন ঝড়ে অনেকটাই উড়ে গিয়েছে, ওপারের গোন গায়ে প্রায়ান্ধকার সেই আলোতে নয়নতারা একটা স্তূপের মতো কিছু পড়ে থাকতে দেখলো বটে। সে কি বিশ্বাস করবে? সে ভয়ে ভয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে শেষে আতঙ্কে কেঁদে উঠে দৌড়লো আবার।