একটা ধাঁধা আছে যা কখনো কখনো, বেশ কিছুদিন ধরে, মনে হতো হরদয়ালের। দশ হাজার রানী ভিক্টোরিয়ার মোহরের থলিগুলো ধীরে ধীরে জোগাড় করতে হয় বটে। কিন্তু সে রকম কিছু কিছু থলি তোষাখানায় আছে তা সে-ই যখন জানতো, রানী কি জানতেন না? ফরাসডাঙার দখল নিতে ম্যাকফার্লানকে ডেকে আগেই থলিটা দিলে হতো। এতসব ঘটার কি দরকার ছিলো? ভরসা–এই ডেপুটি মনোহর সিং-এর বাড়ির ব্যাপারটাকেই তদন্তের বিষয় করেছে। ছেলেটি বুদ্ধিমান, তদন্তটা বিলমহলের দিকে গড়িয়ে দিয়েছে। মরেলগঞ্জ ও ফরাসডাঙার তদন্তের ভার তোকালেক্টরের নিজের হাতেই। গত মাসে ছোকরা একবার এসেছিলো, নায়েবমশায়ের সঙ্গে আলোচনা করেছে, জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তখনই জানা গিয়েছিলো গজার বাড়িতে মনোহরের নাবালিকা স্ত্রীকে পাওয়া গিয়েছে। নায়েবমশায় হরদয়ালকে এসব বলেছিলো। পরে নিজেই আবার বললো, গজার বিপদের কথা তাই রানীমার কানে আনা যাবে না। হরদয়াল বলেছিলো, একদিক দিয়ে ফুটে বেরোবেই, ভালো উকিল দিয়ে কিছু করা যায়?
কিন্তু আসল কথা, কেন এসব? বুদ্ধিমতী রানীর এটা আর-এক হিসাবের ভুল? সেই দশ হাজার তো দিতেই হলো।
.
রাজচন্দ্র এ বিষয়টাকে আর ভাবে না। সেই রাতেই কালেক্টর জিজ্ঞাসা করতে শুরু করলেই সে বলেছিলো, আপনাদের দেশে কী হয় জানি না। আমাদের দেশে নায়েব, দেওয়ান যখন যা করে রাজার হুকুমেই করে। আমার কোনো কর্মচারী কিংবা প্রজাবর্গ কোনো কিছুর জন্য দায়ী হয় না। হরদয়াল, কালেক্টরকে ইংরেজি করে বুঝিয়ে দাও। ন্যায়, অন্যায়, ভালোমন্দর। দায়িত্ব রাজবাড়ির একমাত্র সক্ষম প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হিসাবে আমারই।
তার মনে বাগচী সম্বন্ধে একটা আশঙ্কা ছিলো। বাগচীকে তো নিজের চোখেই সে কালেক্টরের গুলি খেয়ে ঘুরে পড়তে দেখেছিলো। কয়েকদিন পরে যে দাসী ঘরের কাজ করে সে খুব নিচু গলায় বলছিলো, হৈমীদিদি বলেছিলেন শিবঠাকুরের পুরোহিতকে, পুরোহিত আমাকে জানালেন, বাগচীমাস্টার ক্রমশ ভালো হচ্ছেন।
তবে কিছুই আর ভাবার নেই। বাগচী কোথায় তা জেনেই-বা কী হবে? নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেও সে কি ভাবছে? দিনরাত্রি মিলে বর্তমান একটা যেন স্তব্ধ তড়াগ। অতীতকে ভেবেই-বা কী লাভ? একদিন সে ভাবতে গিয়ে হেসে ফেলেছিলো, অতীতকে আমরা মনে আনি ভবিষ্যতের জন্য। বর্তমানের জন্য আদৌ নয়।
একদিন তার ভৃত্য বলেছিলো, হুজুর, রূপকাকা পুরোহিতকে জিজ্ঞাসা করেছিলো, আপনার সকালে বিকালে বেড়ানো হয় কিনা। তা আমি তেলেঙ্গি দুটোকে জিজ্ঞাসা করলাম। তারাও বললো, হুজুরকে তারাও বেড়াতে দেখেনি। মন্দির দিয়ে, মাঠ দিয়ে, নদীর ধার দিয়ে কতই তো বেড়ানোর জায়গা!
রাজচন্দ্র একসময়ে তার সেই নতুন ঘোটকীর কথা মনে করেছিলো। ছুটতে পারে বটে। একবার ছুটিয়ে আনলে শরীর ঝরঝরে হয়ে যায় সারাদিনের মতো। একদিন হঠাৎ তার পিয়ানোর কথা মনে হয়েছিলো। খুবই সত্য যে পিয়ানোর ঘাটে হাত রাখলে মন ফাঁকা থাকে না।
পিয়েত্রোর বাংলোর জানলা দিয়ে নদীর বাঁধানো পার চোখে পড়ে। সে জানে পারের পরেই শুকনো খাত, তার অনেক পরে জল। একদিন বাংলোর বারান্দার রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হয়েছিলো আলোতে নদীর জল কাঁপছে, মৃদু ঢেউ তুলছে। এমন যে চোখে ধাঁধা লাগে, চোখে আর দেখতে পায় না। সে কিন্তু চোখের ভুল, সেখান থেকে নদীর জল চোখে পড়ে না।
কিন্তু রাজবাড়ি থেকেই তো তার আহার ও পরিচ্ছদের উপকরণ আসে। একদিন সেখানে খবর গেলো, রাজকুমার ইদানীং অর্ধেকও খাচ্ছেন না। শরীর কি শুকিয়েছে? রাজবাড়িতে কথা হলো ঝিয়ের বদলে একজন রাঁধুনি পাঠালে হয়। নায়েবের পরামর্শ চাইলে
জানা গেলো, এক আসবে এক যাবে, তাতে তেলেঙ্গিদের আপত্তি কী?
দু-চারদিনে রাজচন্দ্র একবার খেয়াল করলো রান্নার স্বাদে পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এ রকম অদ্ভুত ব্যাপার হলো, যে স্বাদের কথা তুলো আর যে পাত্রটাকে ঠেলে দিয়ে উঠে গেলো তারা এক লোক নয়। সে যখন খেতে বসে সামনে ভৃত্য থাকে, ঝি তার পিছনে। গগাড়া থেকেই তাই ব্যবস্থা। সেও কথা বলে না, তাদের সাহস কী কথা বলে? প্রথম কয়েকদিন তবু ভৃত্য এসে বলতো খেতে দেব, হুজুর? খেতে দেওয়া হয়েছে। এখন সে-ই নিয়মমতো গিয়ে বসে খাওয়ার জায়গায়।
একদিন এক মুহূর্তের জন্য অসাবধানতার ফলে রাঁধুনি ভৃত্যের আগে দাঁড়িয়েছিলো। রাজচন্দ্রর মনে হলো জাল জাল কম দামের শাড়ির পায়ের কাছে কিছু একটা চক চক করছে। সোনার মল? যে সোনার মল দেখলো, যে আহারের স্বাদ নিচ্ছে তারা যেন দুজন মানুষ।
একদিন আবার রাজচন্দ্রর মনে হলো সময় যদি স্রোত হয় তবে তার দহও থাকতে পারে। স্রোতটা বয়ে যেতে থাকলে উপর থেকে কোথায় দহ বোঝা যায় না। কিন্তু স্রোতের গতি কমলে জলটা দহে জমতে থাকে। দহের পার ছাপিয়ে আর বহতা থাকে না।
কয়েকদিন থেকেই নদীর দিকে চেয়ে থাকলে, বিশেষ দুপুর যখন শেষ হতে থাকে, ধুলো ওড়ে। বাঁধের উপরে ঝুঁকে থাকা আকাশে ধূসর রং দেখা যায় হালকা নীলের নিচে নিচে। ইতিমধ্যে একদিন বিকেলে আকাশে একরকমের অদ্ভুত সজে মেঘ দেখা দিয়েছিলো। হলুদ, সবুজ, ধোঁয়ার রং মিলে একটা থমথমে ভাব। হতেই পারে। জ্যৈষ্ঠ শেষ হতে চলে, কালবৈশাখী হয়নি একঘণ্টার জন্যও।