ম্যাকফার্লানের মুখটা কিছু বিবর্ণ হলো।
হরদয়াল বললো– হেসে, আমি বলি কি এখানে এই থলিতে দশ হাজার পাউন্ড সভরেন আছে।
দু-তিন মিনিট ছটফট করলো ম্যাকফার্লান। গলা নামিয়ে বললো, তুমি বলছো–কিন্তু।
এসব ব্যাপারে মনস্থির করতে সময় নেয়। অন্যপক্ষের ধীর শান্ত কোমল প্ররোচনা দরকার। আধঘণ্টা সময় লাগলো। অবশেষে বার্গান্ডি স্পর্শ করলো ম্যাকফার্লান। হরদয়াল ফিসফিস করে বললো, একটা রসিদ সই করে দাও, দুই দিক থেকেই সুবিধা। একটা আই ও ইউ তো। অসুবিধা হলে তুমি বলবে ধার নিয়েছে। আমারও একটা দলিল থাকে।
ম্যাকফার্লান অবশেষে বললো, কিন্তু রাজকুমারকে অ্যারেস্ট তো করতে হবে। কলকাতা আছে।
–অবশ্যই, অবশ্যই।
অবশেষে এই স্থির হয়েছিল, রাজকুমার দু-তিন মাস পিয়েত্রোর বাংলোর নজরবন্দী রূপে থাকবেন। একজন ঝি, একজন চাকর থাকতে পারবে। দুজন সিপাহী বাংলোর বাইরে থাকবে বটে। কিন্তু ওয়ার্ড অব অনার রাজকুমার পালাতে চেষ্টা করবেন না। তারপরে তদন্ত শেষ হবে।
হরদয়াল অতিশয় গম্ভীর মুখে বলেছিলো, ওয়ার্ড অব অনার।
তখন মাঝরাতের কাছে সময়। একটা ধোঁয়ানো মশাল। তার পিছনে একটা ঘোড়া। ঘোড়াটার গলা যেন বৃত্তাকারে মাটিতে ঝুঁকেছে। ঘোড়ার পিঠে স্থির রাজকুমার পিয়েত্রোর বাংলোর দিকে এগিয়ে চলেছিলো।
১৬. মাস দেড়েক চলে গিয়েছে
ষোড়শ পরিচ্ছেদ
তারপরে মাস দেড়েক চলে গিয়েছে। এতদিনে দুএক পশলা বৃষ্টি নেমেছে, কিন্তু এতবড়ো নদীর ধারে বর্ষাকাল এভাবে সাধারণত আসে না। ফরাসডাঙার টিলায় নতুন করে চার্চের ভিত বসেনি। দয়ালকৃষ্ণ ফরাসডাঙার লাট জমা দিয়েছে যেমন সে অনেকদিন থেকে দিয়ে আসছে। ওয়ারিশের প্রশ্ন এবারও ওঠেনি। ম্যাকফার্লান রেভেনু বোর্ডে কী লিখেছে জানা যাচ্ছে না।
রাজনগরের লোকেরা কালক্রমে যে-গল্পটাকে মেনে নেবে তা এখনই কারো কারো মুখে শোনা যাচ্ছে : কী একটা গোলমাল আছে ফরাসডাঙার স্বত্বে, সেক্ষেত্রে দখলদারী প্রমাণ করতে রাজকুমারের স্বয়ং সেখানে থাকা ভালো। রানীর শিবমন্দিরই দখল প্রমাণ করে বটে, রাজকুমার নিজে থাকলে যা হয় তেমন কী করে হবে? রাজকুমারের স্বত্বটা হয় কীসে, সে প্রশ্ন তুললে বলতে হয়, পাল্টা স্বত্ব নিয়েই বা কে এগিয়েছে?
দীঘিটা সব কাটা হয়নি। বিঘা পঁচিশেক কাটা হয়েছে উপর উপর, বৈশাখে জল আসেনি।
নায়েবমশায় ইতিমধ্যে ফরাসডাঙায় পাল্কি থামিয়ে নেমেছিলেন। পত্তনিদারদের দুজনকেই প্রথম ধাপে ডাকিয়েছিলেন। বলেছেন, দয়ালকৃষ্ণ আসবে, তোমাদের নিয়ে আমার সেরেস্তায় যাবে। ভালো দিন দেখে নজর দিয়ে এসো।
নায়েবমশায়ের গা-ঢাকা দেওয়ার গল্পটাকে কাছারির আমলারা হেসে উড়িয়ে দেয়। উনি তো বিলমহলের তসীল কাছারিতে তখন। বছরে একবার করে তো যেতেই হয়।
তবে নাকি ডেপুটির পাল্কির বেহারা বদলে গিয়েছিলো মাঝপথে? তার উত্তরে সদর আমিন বলে, তোমরাও যেমন! বেহারা বদলালে কি হয়? ডেপুটির চার বেহারার পাল্কি ধিকিধিকি করছে তখন। ওদিকে তখন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। বিলমহলের পথও তো সুবিধার নয়। সেজন্যই নায়েবমশায়ের আট বেহারার পাল্কিটা এগিয়ে এসেছিলো। কী? এত মশাল কেন? এই পাল্কি কেন পথে? হুজুর, রাত হয়, আপনার কষ্ট, নায়েবমশায় আপনার জন্য পাঠালেন। ডেপুটি সঙ্গের সিপাহীদের সতর্ক হয়ে আসতে বলে সেই বড় পাল্কিটায় উঠেছিলো। বেহারাদের ভুল। নায়েবমশায় কালেক্টরকে আশা করেছিলেন। ডেপুটি জানলে কি আর নিজের পাল্কি পাঠান? তো, তোমার তেলেঙ্গি সিপাহী কি বিলমহলের জঙ্গলে পথ চিনবে হাতে মশাল থাকলেই? সেদিন গোলমাল ছিলো,নায়েবমশায়ের বরকন্দাজরা ভালো মশাল জ্বালাতে পারেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের মশাল নিবে গিয়েছিলো। কাজেই ডেপুটির পাল্কি আর তেলেঙ্গিরা গেল একদিকে, অন্যপথেনায়েবমশায়ের পাল্কিতে ডেপুটি। অন্ধকারে এরকম আকছার হয়ই। নায়েবমশায় যে কালেক্টরকে আশা করেছিলেন তার প্রমাণ কাহাররা বেদম ধমক খেয়েছিলো। আরে ছোঃ, এ কী? কাকে এনেছো?
সদর আমিন চিরকালই কথায় লোক হাসাতে পারে। ডেপুটি ছো শুনে একটু তেড়ে উঠেছিলো। তা বাপু তখনও সে ক্ষুঃ শোনেনি। তখন নায়েবমশায় গড়গড়ায় মুখ দিয়ে খানিকটা টানলেন। ক্ষুঃ করলেন। পরে বললেন, বুড়ো হয়েছি, বাপু, কথার দোষ নিও না। তুমি তো সেই ঘোষ ছোকরা? তা বলি কুলীন কায়েত? নাকি শ্রীকৃষ্ণের জাত?
ডেপুটি তবু মাথা নাড়া দেয়। তখন নায়েব বলেছিলেন, ছোটো হলেও জাত বটে। তাহলে তোমাকেই জামাই আদরটা দিতে হয়। এটাই গল্পের উৎপত্তি। সত্যি কি আর নায়েবমশায় তাকে কুলীন কায়েতের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে কায়েত করতে চেয়েছিলেন, না, বিল মহলের খাসের তহসীল তাকে বিনা-নজরে পত্তনি দিতে চেয়েছিলেন?
(বিল মহলের খাস তহশীলের আধখানা নিয়ে এক ঘোষ পত্তনিদার বংশে কিছুদিন। আগেও ছিলো বটে। তাছাড়া ও গল্পের, যা নায়েবমশায়ের কাশীলাভের পরে কিছুটা চালু হয়েছিল, যে ঘোষ ডেপুটিকে আটন ফুট লম্বা, দু হাত চওড়া, হাত দুয়েক গভীর কালো একটা অন্ধকার খাদ নায়েবমশায়ের সামনের মেঝে থেকে গালিচা সরিয়ে দেখানো হয়েছিলো, নতুবা সেই বা কায়েত-কন্যাকে কেন শেষ পর্যন্ত বিবাহে রাজী হবে? তার কোনো প্রমাণ নেই)।