-প্রমাণ চাও? যাকগে, সেটা কলকাতার কোর্ট বুঝবে। তুমি নিজে ট্রেসপাস করেছিলে কেন ফরাসডাঙার কুঠিতে? না কি সেটাও কর্তব্য ছিলো? বলবে, রাজকুমার কিংবা মিস্টার । বাগচীকে অ্যারেস্ট করতে? হরদয়াল হাসলো। বললো– আবার, তুমিই বলছিলে, বাগচী প্রথমে, পরে রাজকুমার তোমাদের পরে সেখানে গিয়েছিলো। আর তখন তো কেউ কোনো অপরাধই করেনি।
ম্যাকফার্লান বললো, ট্রেসপাস! সেটাও কি তোমাদের রাজকুমারের বাড়ি নাকি?
হরদয়াল নিশব্দে হাসলো। বললো, এতদিন তো তাই জানতাম, যদিও ওটা রাজকুমারের বাসের উপযুক্ত নয়। তুমি বোধ হয় জানতে না? সেজন্যই আজ সকালে ফরাসডাঙার টিলার কী একটা ভিত গাড়ার সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছো, প্রতিবাদ করোনি? ভেবে দ্যাখোনি, রাজকুমারের কলকাতার গেস্টরা ওই বাংলোতেই ছিলো?
–সিলি!
–কোনটা? ডানকানের মত লোকের গুড ফ্রাইডেতে চার্চ করার ব্যাপারে উৎসাহ?
অন্যমনস্কের মতো ওয়াইনকাপের স্টেমে আঙুল রেখেছিলো ম্যাকফার্লান। সে নিজেকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে সোজা হয়ে বসলো, বললো, তুমি রাজকুমারকে এখানে আসতে বলবে? অথবা আমি কি তাকে অ্যারেস্ট করতে রাজবাড়িতে ঢুকবো?
হরদয়াল বললো, ওয়াইনের বোকেটা কিন্তু আকর্ষণ করে, তাই না? কিন্তু রাজকুমারের অপরাধ কী তাই ভালো করে জানি না। তুমি বলছে, রাজকুমার ডানকান হোয়াইটকে ঘোড়ার ক্রপ-চাবুক দিয়ে চাবকেছে। সে তো শুনেছি ডানকান রাজকুমারকে গাল দেওয়ায়। রাজকুমার যদি তাকে লাথি মেরে থাকে সে তো ডানকান রেভরেন্ড বাগচীর সহধর্মিণীকে বীচ এবং প্রটিচুট বলার রাগে। আর রেভরেন্ড বাগচী যা করেছিলো সে তো সেলফ-ডিফেন্স। ডানকানের রিভলবারটা কার দিকে লক্ষ্য করা ছিলো তা কি বোঝা যায়? তা যে রাজকুমারকে মারতেই তা সে কী করে বুঝবে? ভেবেছিলো হয়তো সে নিজেই তার শিকার। সেলফ-ডিফেন্সে সে ডানকানের কোমরে লাঠি মেরেছে। এমন তো হতে পারে তার জন্য ডানকানের বাতই দায়ী। তাড়াতাড়ি সরে যেতে পারেনি বলেই, বাগচী তাকে চেয়ার তুলেও, মেরেছিলো। কিন্তু ও কাজটা কি তোমার ভালো হয়েছে? তুমি বাগচীকে অত ক্লোজ রেঞ্জে গুলি করলে! হয়তো তার পাটাকে বাদ দিতে হবে, যদি হেমারেজে মৃত্যু না হয়!
ম্যাকফার্লান বললো, তাকেও অ্যারেস্ট করবো। আর তা আজ রাতেই।
-তা কী করে পারবে? আমি তো তাকে আর তার স্ত্রীকে সন্ধ্যাতেই কলকাতায় পাঠিয়েছি। আগে তো বলেনি। এতক্ষণে তারা বিশ-পঁচিশ ক্রোশ চলে গিয়েছে। আশা করছি কাল দুপুরে নাগাদ মেজর চীবসের সাহায্য পাবে। হরদয়াল যেন একটু ভাবলো। বললো– আবার, তা, জয়নাল বুড়ো হয়েছে বটে। কিন্তু প্রায় সাড়ে ন ফুট উঁচু, আর পাগলার মতো ছোটে এখনো; আশা করছি কোল্যান্স না করা পর্যন্ত সে ঘণ্টায় পনেরো-বিশ মাইল ছুটবে, শিকারী হাতি তো।
ম্যাকফার্লানের সন্দেহ হলো, লোকটি কি কথা বলে বলে সময় নিচ্ছে? রাজকুমারকে পালাতে সাহায্য করছে। ইতিমধ্যে নায়েবকে পাওয়া যাচ্ছে না, গা-ঢাকা দিয়েছে সে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, তুমি রাজকুমারকে আনবে? না, আমি রাজবাড়িতে ঢুকবো? স্ত্রীলোকদের সরে যেতে বলবে?
হরদয়াল বললো, বসো, কালেক্টরসাহেব। রাজকুমারকে আনি।
হরদয়াল ভ্রূকুটি করে প্রাসাদে ঢুকলো। রানীর কাছেই দরকার। সে দেখলো রানী তার বসবার ঘরে। রানীর সামনে একটি শেজ। শেজের গোড়ায় রূপার ট্রেতে যা মৃদু আলোয় ঝকঝক করছে তাকে পৃথক পৃথক করে চেনা শক্ত, কিন্তু তা যে নানা দামী পাথর আর সোনার একটা ছোটো স্তূপ তা বোঝা যাচ্ছে। রানী কী ভাবছেন বোঝা শক্ত। অনুশোচনা নাকি তার? কিন্তু একেবারে স্থির। হরদয়াল কথা বলতে গেলো। কী করে যেন, কোথা থেকে যেন হরদয়ালের চোখের কোণ দুটি ভিজে উঠলো।
সে বললো, অতটা নয়। আমি ভাবছি হাজার দশেক পাউন্ড মোহরে। তোষাখানা কি খোলা আছে? চাবিটা? রাজকুমারকে পোশাক পরতে বলুন।
হরদয়াল তোষাখানার চাবি নিয়ে সেখান থেকে একটা থলি সংগ্রহ করে তার বসবার ঘরে ফিরতে মিনিট বিশেক সময় নিলো। টেবিলের ওয়াইনের পাশে একটা জিংলিং শব্দ করে সেই সিল্কের থলিটাকে নামালো। তাকে তখন কিছুটা ক্লান্ত দেখাচ্ছে। বললো, রাজকুমার পোশাক পরছেন।
ম্যাকফার্লান বললো, নো ফানি বিজনেস। তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি।
হরদয়াল তার স্কার্লেটে সাদায় আঙুরলতার নকসা নাইট-গাউনের জেব থেকে একটা কাগজ বার করলো। আলোর সামনে ধরে পড়লো। সেটাকে পকেটে রেখে সিগার ধরালো। তুমি খাবে, কালেক্টর? রিয়্যাল টার্কিশ। অবশ্য তোমার পার্মিশন নিচ্ছি। সে গলা সাফ করলো। আলতো করে গলা নামিয়ে বললো, চরণদাস বলে একজনের কথা জানো?
ম্যাকফার্লান বললো, আমি কী জানি!
হরদয়াল তার জেব থেকে কাগজটাকে বার করলো, বললো, এই কাগজটায় কিন্তু তোমার দস্তখত এবং মোহরও। তুমি কি জানো, ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে যাকে সামন্ করা হয় তাকে অত্যাচার থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব থাকে ম্যাজিস্ট্রেটের? হরদয়ালের এই প্রথম যেন রাগ প্রকাশ পেলো। তার শান্ত মুখে দাঁতগুলো ঝকঝক করে উঠলো একবার। আমি যদি বলি তুমি এখানে আসার কিছু আগেই চরণদাসের কাঁচা কবর খুঁড়েছে আমার লোকেরা। তার বিকৃত শরীরটাও পাওয়া গিয়েছে। তোমার সামনে মনোহর তাকে চাবকাচ্ছিলো। হুকুমটা কি তোমার?