এইসব সোরগোলে কেট ছুটে এসেছিলো। বাগচী কেটের সঙ্গে একটাও কথা না বলে লাঠি হাতে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে গেলো।
.
ঘোটকী তখন তীরবেগেই ছুটছে। রাজচন্দ্র বিরক্ত মুখে ভাবলো, এসব কি নায়েবমশায়ের হুকুম? কে বলেছিলো এখনই তাকে দীঘি কাটাতে? কী লাভ? শুধু কয়েকটা মানুষের প্রাণ যায়! কী হয় ফরাসডাঙার পরগনাটাকে রাজনগরের সঙ্গে যোগ করলে! অকারণে কিছু নরহত্যা। মনে করো ডানকানের কুঠিকে নিশ্চিহ্ন করা হলো, তা কি হাস্যকর প্রস্তাব নয়? বান্দার কথা মনে পড়লো তার। ও, সেই ফেনসিং-বিশারদ কীবল! রাজচন্দ্রর মনে হলো, কাপুরুষ। বান্দার তরোয়াল যে খেলার নয় তা বুঝে দূর থেকে গুলি করে মেরেছে! একটা দুঃসহ ক্রোধ উঠে পড়ছে, ছুটন্ত ঘোটকীর উপরে সেটাকে সে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো। ওদিকে আবার হৈমী কী বোকামি করে বসেছে! রাজকুমারের হাতে তার সবচাইতে শক্তিশালী রাইফেলটা তুলে দিতে পারলেই কি কিছু হয়? এতক্ষণে কি সে ফরাসডাঙায় পৌঁছে গেলো?
সেই খয়েরি ঘোটকী মুখে ফেনা নিয়ে রূপার বিট কামড়ে ধরে যেন চারখানা পায়ে একটামাত্র শব্দ তুলে রাজবাড়ির সদর দরজা পার হয়ে গেলো।
বাঁ হাতের দিকে তখন গাছের মাথাগুলোর উপর দিয়ে পাক খাওয়া সাদা কালো ধোঁয়া, দুপুরের রোদের আকাশকেও লাল করে আগুনের আভা। উভয় পক্ষেই গোপন করার চেষ্টা ছিলো, ফলে সেই গুড ফ্রাইডেতে ঠিক কী ঘটেছিলো তার বিবরণ উদ্ধার করা সহজসাধ্য নয়। দীঘি কাটার সেই জমিটাতে অকরুণ নিচে রৌদ্রদগ্ধ মাটির উপরে দুটি শব পড়ে ছিলো সন্ধ্যা পর্যন্ত। একশো জন কোদালি না হলেও, তখনো কিছু কোদাল যন্ত্রের মতো মাটি কেটে চলেছে।
মরেলগঞ্জের দেওয়ান মনোহর সিং-এর সেই প্রকাণ্ড আটচালাসমেত গোটা বাড়িটা দাউদাউ করে জ্বলছে। গজা মণ্ডল, যার আসল নাম মেন্ডোজা ছিলো একসময়ে, যার কাঁধের মাপ এক গজ বলে নতুন নাম মানিয়ে যায়, সে জানতে পেরেছিলো চরণকে শেষ দেখা গিয়েছিলো মনোহর সিং-এর আটচালাতেই। কিন্তু তন্ন তন্ন করে প্রত্যেকটি ঘর খুঁজেও তাকে না পেয়ে, দড়িতে বাঁধা মনোহরকে লাঠিতে খুঁচিয়েও যখন চরণের সম্বন্ধে জানা যাচ্ছে না, তখন তার সঙ্গের লোকেরা আগুনের ভয় দেখাতে গিয়েই নাকি আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো। চৈত্র-বৈশাখের দিনে সে আগুন কি থামানো যায়? নতুবা গজার ইচ্ছে ছিলো না মানুষকে পুড়িয়ে মারার।
এসবই অনেকপরে গজার বিচারের সময়ে জানা গিয়েছিলো। গজারই শাস্তি হয়েছিলো। নায়েবমশায় দণ্ড কমাতে চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু বোকা রোকনুদ্দিন, কাজটা খুবই ভুল করেছিলো। মনোহর সিং-এর চতুর্থ স্ত্রী, যাকে গজার বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিলো রোকনুদ্দিন, সে গজাকে সনাক্ত করেছিলো।
গজাকে যখন সেই ঘোষজা ডেপুটি ধরে নিয়ে যায় তার আগে সেই ডেপুটির লোকেরা বিলমহলে কবর খুঁড়ে রহিম আর রমজানের শবও বার করেছিলো। তাদের গায়ে তখনো ঘায়ের চিহ্ন ছিলো, কিন্তু সে বিশ্বাস করেনি তা বসন্তের। বরং আগুনের পোড়া হওয়াই সম্ভব এই মত ছিলো তার।
কিন্তু তখন দেওয়ান মনোহর সিং-এর কুঠি দাউদাউ করে জ্বলছে, যদিও দিন শেষ হয়ে আসছে। বিলমহলের থেকে যারা এসেছিলো তারা তখন ফরাসডাঙায় পিছিয়ে এসেছে আর সেই পিছিয়ে যাওয়ার টানে ডিয়ার পার্কের টিলার উপরে চার্চ অব হোলি অ্যাসেনশানের যে ভিত্তি গাঁথা হয়েছিলো তা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।
.
০৩.
বিলমহলের সেই ভিড় দুপুর থেকেই ফরাসডাঙার পথে ছড়িয়ে পিয়েত্রোর বাংলোর এপাশে-ওপাশে অনেকটা সময় ছিলো, তারপরে সন্ধ্যার অন্ধকারে ক্রমশ মিলিয়ে গিয়েছিলো। এরকম প্রমাণ আছে তারা ততক্ষণই ছিলো ফরাসডাঙায় যতক্ষণ রাজকুমার পিয়েত্রোর বাংলোয় ছিলো সেদিন।
পিয়েত্রোর বাংলোয় একই সময়ে কালেক্টর, ডানকান, বাগচী এবং রাজকুমার ছিলো। কী হয়েছিলো সেখানে সেটাই তো আসল গোপন করার বিষয়।
তখন বেশ রাত হয়েছে। দেওয়ানকুঠির বসবার ঘরে হরদয়াল আর ম্যাকফার্লান। মুখোমুখি। হরদয়াল বললো, বসো ম্যাকফার্লান, তোমার সঙ্গে এই প্রথম আলাপ আমার। একটু ওয়াইন আনি?
ম্যাকফার্লানের এই কালো রঙের দেওয়ানটির কথা বলার ভঙ্গিটা ভালো লাগছিলো না। সার তা বলছেই না, নামের আগে মিস্টারও বলছে না। তার এরকমও মনে হলো, আজ সারাদিন যা ঘটেছে তারপরে তিনজনমাত্ৰ সিপাহীর ভরসায় রাজবাড়ির ভিতরে ঢোকা ভালো হয়েছে কি?
হরদয়াল ওয়াইন নিয়ে ফিরলো। গ্লাসে ভরে দিলো। বললো, আমি বার্গান্ডিতে সোড়া খাই না, জলও না। তুমি? তারপরই হেসে বললো, আমি কিন্তু ভেবে পাচ্ছি না তুমি আর হোয়াইট কী করে তখন পিয়েত্রোর বাংলোয় ঢুকলে।
ম্যাকফার্লান বললো, ইংল্যান্ড আশা করে তার ছেলেরা তাদের কর্তব্য করবে।
-আহা, তুমি উত্তেজিত হচ্ছো কেন? ওটা তো নেলসন না কে বলেছিলো, আর তা যুদ্ধের সময়ে। এটা তো সামান্য জমি নিয়ে হাঙ্গামা। তুমি কালেক্টর, নিশ্চয় জানো, রাজকুমারের খরিদকরা জমিতে রাজকুমারের দীঘি কাটানোর এক্তিয়ার আছে। জুড়ান পাইক এবং কীবল ছোকরা ট্রেসপাস করেছিলো। তুমি কি কীবলকে ইতিমধ্যে অ্যারেস্ট করেছো? ট্রেসপাস এবং খুন।
কথা ইংরেজিতে হচ্ছিলো। ম্যাকফার্লান বললো, তুমি আমার ডিউটি আমাকে শিখিয়ে * না। তুমি বলছো মরেলগঞ্জের মধ্যে সেটা রাজকুমারের জমি?