রাজচন্দ্র ভাবলো : একসময়ে সে কিন্তু ভাবতো, পিয়েত্রোর গল্প শোনার পর, যদি পিয়েত্রোর আত্মীয়া সেই রানী তাদের বাড়িরই হতো তবে ভালোই হতো। এরকম হয় না, হলে ভালো হতো, এরকম অনুভব করেই সে মায়ের কাছে প্রস্তাব করেছিলো অসুস্থ পিয়েত্রোকে রাজবাড়িতে এনে রাখতে। রানী বলেছিলেন, মানুষ বয়স্ক হলেই একা হয়ে যায়, তিনি নিজের কথা, পিয়েত্রোর কথা তুলে যেন একা হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বুঝিয়েছিলেন। তখন পিয়েত্রো তার আত্মীয় জানলে সে কি আর রানীর কথা শুনত? শেষে কিন্তু পিয়েত্রোর মৃত্যুর মুহূর্তে দয়াশীলা রানী পিয়েত্রোর নিভে আসা চোখের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন একবার।
এই সময়েই হঠাৎ যেন রাজচন্দ্র এতদিনে নিজেকে প্রাপ্তবয়স্ক মনে করলো। ওটা তো ভালোবাসার গল্পই। বিচিত্র সুঘ্রাণের ভালোবাসা। সে মনে মনে হাসলো, যেন মনে মনেই বললো, তাহলে কিন্তু রানীমা মা থাকে না। আমাদের মতো মানুষ হয়ে যাও, যার নিজের সুখ-দুঃখ আছে।
সে অনুভব করলো, এতদিন কি সে মায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলো, আর এখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে মায়ের থেকে পৃথক হয়ে যাচ্ছে?
প্রথমে পায়ের শব্দ, তারপর দেখতে পেলো রূপচাঁদকে। সে ভাবলো, তাহলে কিছু না করে, কিছু না ভেবে পুরো দিনটা কাটিয়ে দিয়েছে নাকি? হয়তো বনের বাইরে সূর্য ঢলে পড়ছে। কিন্তু রূপচাঁদ হাঁপাচ্ছে, ছুটে এসেছে সন্দেহ কী?
রূপচাঁদ বললো, হুজুর আপনি এখানে?
–এখানে কী দোষ করেছে?
রূপচাঁদ বললো, ওদিকে যে সর্বনাশ! শিগগির চলুন। আপনাকে নিয়ে যেতে না পারলে হৈমীদিদি আমাকে সদরদরজার সামনেই গুলি করে মারবে বলেছেন। নিজেও সেখানে দু তিনজন বরকন্দাজ নিয়ে পথ আগলাচ্ছেন।
রাজচন্দ্ৰ কপট আশঙ্কায় বললো, সে কী রে, হাতে কি বন্দুকও নাকি?
রূপচাঁদ বললো, আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর, আপনার রাইফেলই একটা আর তাতে গুলিও ভরা।
এবার রাজচন্দ্রকে উঠে বসতে হলো। সে কারো তার রাইফেল ছোঁয়া পছন্দ করে না। সে বিরক্ত হয়ে বললো, এসব কেন?
রূপচাঁদ বললো, হুজুর, বান্দাকে মেরে ফেলেছে।
বান্দাকে? কে? কেন?
বান্দা মরেলগঞ্জের নতুন জমিতে পুকুর কাটাতে গিয়েছিলো একশো কোদাল নিয়ে। জুড়ান পাইক সড়কি চালালে বান্দা তাকে দুফালা করে ফেলেছিলো। তখন কীবল এসে দূর থেকে বান্দাকে গুলি করে মেরেছে। হুজুর, শিগগির চলুন। ওদিকে আরো। ফরাসডাঙায় গিয়েছে গজা মণ্ডলের দল। সাহেবদের ভিতের পাথর গাড়ার কাজ ভেঙে উড়িয়ে দিতে।
সেখানে শুনি কালেক্টর, তার ফৌজ, ডানকান আর কে কে সব সাহেব!কটার বা প্রাণ গেল। সেখানে! আপনাকে কোথাও না পেয়ে আপনি ফরাসডাঙায় ভেবেমাসি পাল্কি করে সেদিকে। গেলেন। কী যে বিপদ! আমাকে বললেন, রূপচাঁদ, রাজকুমারের হাতে যে বন্দুকটা। সবচাইতে ভাল চলে সেটা দাও পাল্কিতে। গুলি আর বন্দুক তুলে নিয়ে বেহারাদের বললেন, উড়ে চলো, বকশিশ দেবো। রূপচাঁদ কেঁদে ফেলো, হুজুর, আমারই ভুল। আমি বলেছিলাম, রাজকুমার খালি হাতে বেরিয়েছেন।
রাজচন্দ্রের ঘোড়া ততক্ষণে ধাপে ছুটতে শুরু করেছে।
.
০২.
বাগচী ভাবছিলো আজ সারাদিন সারারাত লিখেই কী শেষ করতে পারবে–এই শেষ দুটি ওষুধের কথা? ইতিমধ্যে বেলা দুটো হয়ে গেল। চরণের হাতে এ দুটি ওষুধ কত যন্ত্রণা কত হতাশাকেই না দূর করতে পারবে! কত রকমেরই তো দুঃখ, যন্ত্রণা, অপমান, হীনতা! তাদের পক্ষে অনেকগুলিই দূর করা সম্ভব নয়। আত্মার যন্ত্রণা, মনের যন্ত্রণার কিছুই কি করতে পারে তারা। কিন্তু দেহের যন্ত্রণার কিছু লাঘব করতে চেষ্টা করা সম্ভব। রোগগ্রস্ততাও তো একরকমের হীনতা, অপমানও বটে। সে স্থির করলো এই রকম পাইপ টানার জন্য যে সময় ব্যয় হবে তাছাড়া অন্য সময়টুকু সে লিখে যাবে। সে অবশ্যই এ পর্যন্ত ক্রাইস্টের কাছে ঈশ্বরজ্ঞানে কিছু চায়নি। কিন্তু তার হাতের স্পর্শে যে নিরাময়গুলি সম্ভব হয়েছিলো তেমন নিরাময়কেই সে প্রার্থনা করছে এখন।
অস্বাভাবিক শব্দে বাগচী তার স্টাডি থেকে বেরিয়ে এসেছিলো। কেট অবশ্যই এখন কিচেনে, তার কুঠিতে এরকম সব শব্দ কেন হয়? সে দেখতে পেলো, এক উন্মাদিনী বিলাপ করতে করতে তার কুঠিতে ঢুকে পড়েছে। খোলা চুল পিঠের উপরে। হয়তো ছুটতে গিয়ে পড়ে গিয়ে থাকবে, ফলে বিস্বস্ত শাড়ি ঘেঁড়াও বটে। তার প্রথমেই মনে হলো সে কি কেটকে কিছু পোষাক আনতে বলবে? তার এরকমও মনে হলো, হায়, এ কি মরেলগঞ্জের কোনো উৎপীড়িতা? সেই উন্মাদিনী হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, সে চরণের বউ। চরণকে কাল সন্ধ্যার সময় কালেক্টরের পেয়াদা ধরে নিয়ে গিয়েছে। এখনো ফেরেনি। আর কী ফিরবে? এই কাগজ দেখুন।
চরণের স্ত্রীর বনদুর্গা বোধ হয় তার শক্তির শেষ সীমায় এসেছিলো, সে হাহাকার করে কেঁদে বসে পড়লো। কাগজটাকে পড়ে বাগচী পকেটে পুরলো। সে বলতে গেলে, চরণের বউ, তুমি কেঁদো না। আমি এখনই এই মুহূর্তে যাচ্ছি, দেখবো কেমন কালেক্টর, আর কেমন তার বিচার! কিন্তু হঠাৎ তার প্রচণ্ড রাগ হয়ে গেলো। পার্লারের কোণে তার নানারকম ওয়াকিং স্টিক। সে সবচাইতে মোটা আর বড়ো মালাক্কা বেতের লাঠিটাকে বেছে নিয়ে সেটাকে মেঝেতে ঠুকতে ঠুকতে বললো, তুমি কিছু ভেবোনা, কিছু ভেবোনা, চরণের বউ। সীমা আছে অত্যাচারের। ভারি ইংরেজ হয়েছে! ভেবেছে আমার গায়ের রং কালো বলে ওরা আমার চাইতে বড় ইংরেজ! আমি টাইমসে লিখবো, আমি পার্লামেন্টে কোশ্চেন তুলবো। আমি, আমি-আমি চরণকে না নিয়ে ফিরবো না।