রাজকুমার আর বাগচীও উঠে দাঁড়ালো। রাজকুমার যেন কৌতুক দেখেছে এমনভাবে বাগচীর দিকে চেয়ে হাসলো।
তখন কাছারি পুরোদমে চলেছে। নায়েব তার খাসকামরায় ঢুকে দু-চার মিনিট চুপ করে বসে রইলো। তামাক দিতে বললো। ল-মোহরার আসবার অনুমতি চাইলে বললো, বিকেলে। জমানবিশ নিজে এলে বললো, তোমাকে ডাকিনি, আমিনকে। জমানবিশ চলে গেলে তার খাসবরদারকে বললো, রাজবাড়ির নতুন রসুইওয়ালা বান্দাকে চেনো? তাকে বলবে ডেকেছি। আমিন এলে বললো, বিল মহলের গজাকে চেনো? কাল ভোরে তাকে চাই। বেরিয়ে পড়ো, মুখের এত্তেলা নয়। নায়েব গড়াগড়ার নল রেখে বারান্দায় এলো। বরকন্দাজদের একজনকে দেখে আঙুলের ইশারায় ডাকলো। সে এলে বললো, বুনোদের রেমো আর পেল্লাদকে চেনো? সন্ধে নাগাদ কাছারিতে আসে যেন। সে আবার তার খাস কামরায় ঢুকলো, ল-মোহরারকেই ডাকলো এবার। খাওয়া-দাওয়া করে সদরে যাও তো। ইদিক-উদিকে খবর করো, গুড ফ্রাইডে নাকী আছে তোমাদের, সেই ছুটি কাটাতে কালেক্টর কোন দিকে যাচ্ছে?
হরদয়ালও চিন্তা করতে করতেই তার কুঠির দিকে চলেছিলো। এটা কিন্তু খুব বিস্ময়ের হবে যদি প্রমাণ হয় যে জাঁ পিয়েত্রো রানীর আপন পিসিমার ছেলে। আর এখন তো তা প্রমাণ হলোই। সে ভাবলো, তাহলে কি রানীর খৃস্টান ধর্ম ও ইউরোপীয় সংস্কৃতি সম্বন্ধে অনেক মনোভঙ্গির বিশ্লেষণ হয়? তার মনে পড়ে গেলো, রাজকুমার বালকত্ব পার হয়ে কৈশোরের দিকে যেতে তার শিক্ষাদীক্ষার ভারই যেন পিয়েত্রো বুজরুকের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। অন্তত দিনের অনেকসময়েই ফরাসডাঙায় কাটাতো রাজকুমার। একটা পক্ষপাতই ছিলো যেন রানীর রাজকুমারের বেড়ে ওঠার ব্যাপারে।
সে যখন তার কুঠিতে ঢুকেছে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। সিঁড়ির উপরে যেন রাজবাড়ির দিকে ফিরে কিছু দেখবে। সে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলো, এখন তাহলে কি ব্যাপারটা বোঝ যাচ্ছে? এমন কী হতে পারে, সেই বিশেষ এক রাতে যখন রাজকুমারকে বুজরুকের সহায়তা করতে সে বাধা দিয়েছিলো তখনই রানী ক্রুদ্ধা হয়েছিলেন? সেজন্যই কি তাকে পদচ্যুত করা হয়েছে? বুজরুকের পরিকল্পনা যে পিয়েত্রোরও পরিকল্পনা তা তো সহজেই জানা যায়। কিন্তু এ কি সম্ভব, রানী ভেবেছিলেন এই রাজবাড়ি, বিশেষ রাজকুমার, সেই ৫৭-এর ব্যাপারে জড়ায়? কী হতো? কী লাভ হয়েছে কার? কিংবা রানী নিজেও কি বুঝেছিলেন পরিকল্পনা ব্যর্থ হবেই? তা সত্ত্বেও পিয়েত্রোর কাছ থেকে রাজকুমারকে সরিয়ে আনাও সহ্য করতে পারছিলেন না? তার পদচ্যুতি কি এক দুঃসহ নিরুপায় ক্রোধের প্রকাশমাত্র? তাতে কিন্তু প্রমাণ হয়, পিয়েত্রো রানীর কত কাছের মানুষ ছিলেন। কিন্তু কোনোদিনই কি কেউ পিয়েত্রোর সঙ্গে কথা বলতে দেখেছে তাঁকে?
.
সেদিন গুড ফ্রাইডে।
বাগচী দু-তিন দিন আগেই বলেছিলো, রাজকুমার, ছুটি চাই। একটা বই লিখে শেষ করতে হবে। আর তিনদিন সময়মাত্র হাতে। রাজকুমার বলেছিলো, ছুটি নয়, বই লেখার জন্য অবসর। বাগচী সেই সন্ধ্যার পর থেকে আসছে না।
কারো কথা ভাবতে গেলে মন অনেকসময়ে তাকে যেখানে শেষ দেখেছিলো সেখানে ফিরে যেতে পারে। বাগচী না আসায় তার সন্ধ্যাগুলো ফাঁকা যাচ্ছে এই অনুভূতি থেকে তার মন যেন বাগচীকে অনুসরণ করে তার কুঠিতে গেলো। তার মনে পড়লো, সেদিন বেশ হাসাহাসি হয়েছিলো কিন্তু নয়নতারার দীঘির জমি দেখার কথা নিয়ে। আর বোধ হয় পিয়েত্রোর তরোয়াল নিয়েও। আর সেই সময়ে, তার মনে পড়লো, পিয়ানোর ডালায় সেই রূপার ফলকে, পিয়েত্রোর পিয়ানোই তো সেটা, লেখা সেই বাইচেনাম। ও, সেই চতুর্দশীর সুঘ্রাণ! সেই বাইচে যে নাকি পিয়েত্রোর আদরের মামাতো বোন।
রূপচাঁদ এসে জিজ্ঞাসা করলো, রাজকুমার তখনই বাইরে যাবেন কিনা?
রাজচন্দ্র বললো, তা দিয়ে তোমার কী হবে? তুমি দুলকিকে আনতে বলল।
কিন্তু রূপচাঁদ যাওয়ার আগে রাজচন্দ্র তাকে থামিয়ে বললো, হারে রূপচাঁদ, তোর সঙ্গে কাঠের মিস্ত্রির জানাশোনা আছে? তুই কি গাছের উপরে সেই দুখানা ঘরের বাড়ির দেখেছিস? আমি জানতে চাইছি, সেই গাছের আর একটু নিচের দিকে আর খানদুয়েক ঘর হয় কিনা? মিস্ত্রিরা পারে কিনা? কাঠের সিঁড়িও করে দিতে হবে এঘরে ওঘরে যোগ করে। সব মিলিয়ে একটা বাড়ির মতো। খোঁজ নিয়ে জানাস তো আজ সন্ধ্যায়। আর একটা কাজ করিস। পিয়ানোটাকে ভালো করে মেপে নিবি। গাছের উপরে যে ঘর দুটো তার কোনটিতে সেটাকে বসানো যায় কিনা দেখে আসিস একসময়ে।
রূপচাঁদ বললো, আজ্ঞে আচ্ছা। কিন্তু সেখানে কি রাজকুমার একা থাকবেন?
-তুই বুঝি যেতে চাস?
–আজ্ঞে না, সে আমার বেশ ভয় করবে। আপনারও খুব একা লাগবে?
–আচ্ছা বাঁদর হয়েছিস। যা, সহিসকে ঘোড়া আনতে বল।
রূপচাঁদ চলে গেলে রাজচন্দ্র ভাবলো, কী যেন সে ভাবছিলো? হৈমীর কথা? না, হৈমী কাল রাতে বলছিলো মুকুন্দর চিঠি এসেছে চীন থেকে। আর তা নিয়ে কাদম্বিনীই এসেছে কায়েতবাড়ি থেকে। হৈমীর কথাতেও বোঝা যাচ্ছিলো মুকুন্দ প্রকৃতপক্ষে এই রাজবাড়িরই কুমার বটে। এসব ভাবতে কিন্তু অবাক লাগে। আগেকার মানুষগুলোকে একটু স্পষ্ট করে চেনা যায় যেন।
সহিস রাজচন্দ্রের কথা মতো অর্থাৎ তার খয়েরি রঙের প্রিয় ঘোটকীটাকেই এনেছে।
রাজচন্দ্র ঘণ্টাখানেক চলে গাছ-ঘরের কাছে পৌঁছে গেলো। ঘোড়াটাকে ঘরে উঠবার মই-সিঁড়ির রেলিং-এ বেঁধে দিয়ে সে বরং আতপ্ত ঘাসের উপরে বসলো।