কিছুদুরে যখন কীবল ডানকানের কাছে পৌঁছেছে, মনে হলো ডানকান কিছু বললো, আর তা শুনে কীবল হাসলো। পরে ডানকানও হো হো করে মদো গলায় হাসলো। ঘোড়ার উপরে একবার সে শোয়ার চেষ্টা করলো যেন, পরে সেটাকে কাটিয়ে উঠলো। হাজার হলেও ইংরেজ তো।
.
০৭.
সস্ত্রীক বাগচী পিয়েত্রোর বাংলোর বারান্দায় গাড়ির জন্য অপেক্ষা করলো। গাড়ি অর্থাৎ গোরুর গাড়ি। জেনে রাখা ভালো, মরেলগঞ্জে দু-তিনখানা ঘোড়ায় টানা গাড়ি আছে। রাজার গ্রামে যানবাহন বলতে পাল্কি, ডুলি, গোরুর গাড়ি, হাতি, ঘোড়া বুঝিয়ে থাকে। মরেলগঞ্জের ওরা কুঠি তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর থেকে দক্ষিণ এবং পূর্ব থেকে পশ্চিম যোগচিহ্নের মতো দুটো সুরকির সড়ক তৈরি করেছে। সে জন্যই কি ঘোড়ার গাড়ি? যদিও বর্ষা ছাড়া অন্যসময়ে প্রচুর ধুলো উড়িয়ে মরেলগঞ্জের বাইরে এ গ্রামে ও গ্রামে মরেলগঞ্জের এক্কা ফিটনগুলি চলে। এটা এক আধুনিকতা যা রাজার গ্রামে এসেও আসছে না।
কথা বলছ না যে? –কেট বললো।
বলছি তো। আমি বেশ একটু অবাক বোধ করছি। বাগচী বললো–রেলগাড়ি হলে স্টিমার জাহাজও হতে পারে, কিন্তু কত তাড়াতাড়ি হলো তা দ্যাখো। কিছুদিন আগেই হয়েছে, আমরা খবর রাখিনি। কলকাতা থেকে দূরে।
কেট হঁ বলে নিজের চিন্তায় আবার ফিরলো। চিন্তার অনেক বিষয়ই থাকতে পারে। পিয়েত্রোর বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে যে অনুভূতি তার হচ্ছে তা নিয়ে কি আলাপ করা যায়? কখনো সেপিয়েত্রোকে দেখেনি। কিন্তু এটা পিয়েত্রোর বাংলো, যার মতো আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব এদিকে কম দেখা যায়। সামনে পিয়েত্রোর হাওয়াঘর যেখানে মন্দিরটা উঠছে, আর, গুজব অনুসারে, যেখানে সিপাহীবিদ্রোহের আগুনের আভা দেখা দিয়েছিলো। বাগচী কিছু জানে। কিন্তু বাগচী বললো, আমরা ক্রিমিয়ার কথা কতটুকু জানতাম?
–আমরা ইংরেজি সংবাদপত্র পড়ি না।
হুঁ। কেন পড়ি না? ইংলিশম্যান পছন্দ হয় না? রোসোআজ থেকেই ব্যবস্থা হবে। দেওয়ানসাহেবের টাইমস আসে। চেয়ে আনলেই হলো।
-আচ্ছা, লন্ডনের মে-ফেয়ারের মহিলা হসপিটালে সোলজারদের নার্স করছে–এটা কি সমাজে আলোড়ন আনে না?
-আনে। বোধ হয় স্টিমারের চাইতে কম নয়। যদিও আমি জানি না স্যার সিডনি এখন ঠিক কোন পদে আছেন। মনে হয় এটা লন্ডনের একেবারে নতুন খবরের একটা। আর সেজন্যই কীবলের বিস্ময়।
বাগচীও যেন কিছু ভাবছে। তা কি লন্ডনে যে পরিবর্তন হচ্ছে তার কথা?
কিছুক্ষণ পরে কেট আবার বললো–আচ্ছা, মোকাবেলা কথাটার মানে কী?
–দেওয়ানজি যা বলেছিলেন, সামনা-সামনি হওয়া বলতে পারো। তবে তোমার আমার মুখোমুখি হওয়া নয়। সাধারণত একটা বিপদ বা আশঙ্কার আভাস পিছনে থাকা চাই।
অল্পসময়েই তাদের গাড়িটা এলো। গোরুগাড়িটা অসাধারণ কিছু নয়। কিন্তু তখনকার দিনে অর্থবান লোকেরা ব্যবহার করতো বলে পরিচ্ছন্ন এবং চোখের পক্ষে তৃপ্তিকর রাখার চেষ্টা ছিলো।
বাগচী হাসলো–কিন্তু, ডার্লিং, এটাও কি একরকমের টাইমলেসনেস নয়–ওই কাগজ পড়া?
কেট বারান্দা থেকে নেমে গাড়ির দিকে রওনা হলো, বললো–এসো, আমি কিন্তু এই সময়হীনের শকট থেকে হেঁটে যাওয়া পছন্দ করতাম।
কেটকে হাত ধরে গাড়িতে তুলতে গিয়ে বাগচী বললো–এর চাইতে ভালো হতো ঘোড়া। এরপরে এরকম কোথাও যেতে হলে দেওয়ানজিকে জোড়া ঘোড়ার কথা বলবো।
কেট বলেছিলো, সে তো পরে। আজ এ ব্যাপারটাকে সামলে নিই।
তার মুখ সত্যি কিছু বিবর্ণ।
এখন, গোরুর গাড়ির এই অভ্যাস যে তা আরোহীকে নানারকমে পরীক্ষা করে থাকে। এপাশ থেকে ওপাশে গাড়িয়ে, সাধারণভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে, উপর থেকে নিচে ছোটোখাটো আছাড় দিয়ে সে পরীক্ষা। তখন কোনো চিন্তা করা যায় না, করলেও চিন্তাই বরং ভেঙে টুকরো হয়ে যায়।
দুএকবার বাগচী হেসে উঠলো গাড়ির রসিকতায়, কেট অনেকবার কুটি করলো। একবার কেট মনে করলো রানীমার এই লাঞ্চ সম্বন্ধে আলোচনা করবে–এটা তার রাজনীতি হতে পারে যার স্বরূপ কিছু না বুঝে তাকে সার্থক করতে তারা আজ সহায়তা করেছে। যদিও তারা রাজকর্মচারী নয়। কেন আদৌ তাদের এ লাঞ্চে যোগ দিতে হলো। বাগচী বলেছিলো দেওয়ানজি বলেছেন। আর তোমাকেই হোস্টেসের দায়িত্ব নিতে হবে। দেওয়ানজি শুধু নিয়োগকর্তা নন। বলা যেতে পারে বন্ধু, পেট্রন। কিন্তু তাদের নিজেদের মনের মধ্যে কি দ্বিধা ছিলো না? কিন্তু ঠিক তখনই গাড়ির আচ্ছাদন, যাকে ছই বলে, কেটের মাথা তাতে ঠুকে গেলো। কেট মুখ লাল করে সামলালো কিন্তু চিন্তাটা ভেঙে গেলো।
গাড়িটা যখন রাজার গ্রামে ঢুকছে কেট তখন বললো–তুমি কি এর মধ্যে মরেলগঞ্জে যাচ্ছো নাকি?
-কেন? সেখানে কী?
–যদি ক্ষমা চাইতে ইচ্ছা হয়।
–এই দ্যাখো! কী অন্যায় করেছি কখন? তা মদ একটু বেশিই হয়েছে আজ। তার জন্য কার কাছে ক্ষমা চাইবো?
–আমার ধারণা ছিলো পাদরিরা সত্য বলে থাকে।
বাগচী হেসে উঠলো। –আ ডার্লিং, যদি সত্যি পাদরি হতাম।
অনেকসময়ে কিন্তু সাধারণ একটা দিনেও চিন্তা গুরুতর হয়ে যায়। বাগচীর মনে খানিকটা অনুপ দেখা দিলো। মদ খাওয়ার কথা মনে এলো তার। মদ স্পর্শ করবো না বলাটার মধ্যে একরকমের গোঁড়ামি দেখা দিচ্ছিলো বলে মদ একটু খেয়েছিলো সে। তখন সে ভেবেছিলো খাওয়া না খাওয়া কোনোটাকেই সে মূল্যবান করতে চায় না। কিন্তু তার ফলে কি খাওয়ার দিকে ঝোঁক আসছে? বিষণ্ণ লাগছে না? এই দ্যাখো, আমি ভাবতাম আমার চরিত্র ইতিমধ্যে কিছু স্থির হয়েছে।