“কী জিনিস?”
“তুই সবসময় এক দিকে তাকিয়ে থাকিস। তোকে এদিক-সেদিক তাকাতে হবে। সব মানুষ খামোখা এদিক-সেদিক তাকায়। যখন কারো সাথে কথা বলবি তখন তার দিকে তাকাবি।”
আঁখি বলল, “ঠিক আছে।”
আমরা আঁখিকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে গাড়িতে এসে উঠলাম, কেউ একবারও আঁখির দিকে ঘুরে তাকাল না।
সবাইকে নিয়ে আবার গাড়ি ছেড়ে দিল। আবার আমরা আঁখির জন্যে ধারা বিবরণী দিতে লাগলাম। দুই ঘণ্টা পর আবার গাড়ি থামল তখন আবার আঁখি স্বাভাবিক মানুষের মতো নেমে এল, আমরা সাবধানে তাকে হটিয়ে নিয়ে গেলাম, কেউ তার দিকে ঘুরে তাকাল না, কেউ আহা উঁহু করল না!
.
আমরা চট্টগ্রাম পৌঁছলাম দুপুরবেলা। একটা গেস্ট হাউসে বলে রাখা ছিল, আমরা সেখানে গিয়ে উঠেছি। দুপুরে খাওয়ার জন্যে নানা রকম আয়োজন। সারা রাস্তা আমরা খেতে খেতে এসেছি, পেটে খিদে নেই। তারপরেও আমাদের ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে হল। খাওয়ার পর সবাই একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার আমরা রওনা দিয়ে দিলাম।
সাধারণত গাড়ি ছাড়তেই নিশাত আপু সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন, এবারে কেন জানি আর ঘুমালেন না। পিছনে বসে বসে আমাদের গল্পগুজবে মাঝে মাঝে যোগ দিতে লাগলেন। রিতু গুছিয়ে কথা বলতে পারে তাই সে নিশাত আপুর সাথে নানা বিষয়ে কথা বলতে থাকে। ডাক্তারি পড়া কি কঠিন, যখন লাশ কাটতে হয় তখন কি ভয় করে, যদি কোনো রোগী মারা যায় তখন কি মন খারাপ হয় এ ধরনের নানা রকম প্রশ্ন! শান্তা জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি আগে বান্দরবান গিয়েছেন?”
নিশাত আপু হেসে বললেন, “কতো বার! আমার কিছু করার না থাকলেই বান্দরবানে চলে আসি।”
সুজন জিজ্ঞেস করল, “বান্দরবানে কি বান্দর আছে?”
“আছে। আগে আরো অনেক বেশি ছিল, এখন কমে গেছে।”
মামুন সুজনকে বলল, “তুই যখন যাবি, তখন আবার একটা বেড়ে যাবে।”
আমরা সবাই হাসলাম, সুজনও হাসল, বলল, “ঠিকই বলেছিস, আমার সবসময় মনে হয় মানুষ না হয়ে যদি বান্দর হয়ে জন্মাতাম তা হলে কী মজাটাই হত! সারা দিন এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফাতে পারতাম!”
রিতু বলল, “তুই মন খারাপ করিস না। আমরা তোকে রেখে আসব। তুই মনের সুখে এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফাতে পারবি?”
আমি নিশাত আপুকে জিজ্ঞেস করলাম, “বান্দরবানে আমরা কোথায় থাকব?”
“নতুন একটা রিসোর্ট তৈরি হয়েছে সেখানে। ছোট চাচা, মানে আঁখির আব্বুর একজন বন্ধু তৈরি করেছেন। পাহাড়ের উপর একেবারে ছবির মতোন। নিচে তাকালে দেখা যায় শঙ্খ নদী।”
সুজন বলল, “খাওয়া দাওয়া?”
“সেখানেই হবে। খুব মজার খাবার তৈরি করে। আমি যতবার যাই ততবার খেয়েদেয়ে আরো মোটা হয়ে আসি!”
সুজন জিজ্ঞেস করল, “জঙ্গলে বাঘ ভালুক আছে?”
“গভীর জঙ্গলে নিশ্চয়ই বন্য পশুপাখি আছে। আমরা যেখানে থাকব সেখানে নেই। তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”
শান্তা জিজ্ঞেস করল, “আমরা সেখানে কী করব?”
“তোমাদের ইচ্ছা। শঙ্খ নদীতে নৌকা করে গভীরে যেতে পার। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি করে ঘুরে বেড়াতে পার। কিছু করার ইচ্ছে না করলে রিসোর্টের বারান্দায় চুপচাপ বসে থেকে জঙ্গলের শব্দ পাখির ডাক শুনতে পার।”
আঁখি বলল, “সেটাও যদি করার ইচ্ছা না করে তা হলে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে ঘুমাতে পারিস!”
আমরা হি হি করে হাসলাম, সুজন বলল, “ইস! আমরা এতো দূর থেকে ঘুমানোর জন্যে এসেছি না কি?”
.
আমরা যখন বান্দরবানে আমাদের রিসোর্টে পৌঁছেছি তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। পাহাড়ি রাস্তায় একেবারে গভীর জঙ্গলে অনেক দূর যাবার পর আমরা একটা বড় গেটের সামনে থামলাম। পাহাড় কেটে সিঁড়ি করা হয়েছে, সেই সিঁড়ি ধরে হেঁটে হেঁটে আমরা উপরে উঠে গেলাম। ভালো জামাকাপড় পরা একজন কমবয়সী মানুষ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল, আমাদের দেখে ব্যস্ত হয়ে বলল, “এসো এসো, সবাই এসো। আমরা অনেকক্ষণ থেকে তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছি। ভেবেছিলাম তোমরা আরো আগে পৌঁছবে!”
জাবেদ চাচা বললেন, “আমরা খুব ধীরে সুস্থে এসেছি ম্যানেজার সাহেব। কোথাও কোনো তাড়াহুড়ো করিনি। স্যার বলে দিয়েছিলেন প্রতি দুই ঘণ্টা পর থামতে।”
“সেটাই ভালো।” ম্যানেজার সাহেব বললেন, “তোমরা এসো তোমাদের রুমগুলো দেখিয়ে দিই। তোমাদের ছয়জনের জন্যে আমি সবচেয়ে ভালো ঘরগুলো রিজার্ভ করে রেখেছি। একেবারে পাহাড়ের উপর দুইটা রুম, তিনজন তিনজন করে ছয়জন। এসো আমাদের সাথে।
আমরা ম্যানেজারের পিছনে পিছনে হেঁটে যেতে থাকি। আঁখি রিতুকে ধরে হাঁটছে, আমি আঁখির পিছনে। রিসোর্টের দুইজন মানুষ পিছনে পিছনে আমাদের ব্যাগগুলো নিয়ে আসতে থাকে। আমরা গাছগাছালি ঢাকা একটা পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে মনে হয় আরো একটা পাহাড়ের উপর উঠে গেলাম। সেখানে কাঠের একটা বাসা, দুইপাশে দুইটা রুম। ম্যানেজার সাহেব রুমগুলো খুলে বললেন, একটাতে তিনজন অন্যটাতে তিনজন, নিজেরা নিজেরা ঠিক করে নাও কে কোথায় থাকবে।”
রিতু একটা ঘরে ঢুকে এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, “আমরা এইটাতে থাকব।”
কাজেই আমি সুজন আর মামুন অন্যটা নিয়ে নিলাম। হোটেলের মানুষগুলো আমাদের ব্যাগগুলো নিয়ে এসেছে। তারা সেগুলো আমাদের রুমে পৌঁছে দিয়েছে। আঁখি জিজ্ঞেস করল, “নিশাত আপু আর জাবেদ চাচা, আপনারা কোথায় থাকবেন?”
ম্যানেজার সাহেব বললেন, “পাশের রকে। তোমাদের কোনো ভয় নেই গাছপালায় আড়াল হয়ে আছে কিন্তু জোরে ডাক দিলেই শুনতে পাবে।”