পাহাড়ের মতো মানুষটা একেবারে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল, দুর্বলভাবে বলল, “আমি দেখলাম ঢিল ছুড়ছে”
পুলিশ অফিসারটা বললেন, “ডোন্ট টক ননসেন্স। এই মুহূর্তে ওদেরকে ওদের জায়গায় পৌঁছে দিয়ে আস।”
“জি স্যার।”
আঁখি বলল, “থ্যাংকু। আপনাকে অনেক থ্যাংকু।”
পুলিশ অফিসারটি বললেন, “তুমি কিছু মনে কোরো না মা।”
আবার গাড়ি ছেড়ে দিল, এবারে অবস্থা পুরোপুরি অন্যরকম। পাহাড়ের মতো মানুষটা মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “তোমরা সবাই অন্ধ?”
মামুন বলল, “হ্যাঁ।–”
আমি সুজনকে দেখিয়ে বললাম, “অন্ধ না হলে কি কেউ এইরকম কালো চশমা পরে?”
“কিন্তু, দেখে বোঝা যায় না।”
সুজন বলল, “আমরা যেহেতু চোখে দেখি না তাই বেশিরভাগ কাজকর্ম করি কানে শুনে। আমাদের কান খুব ভালো। সবকিছু আমরা শুনি। শুনে বুঝে ফেলি।”
রিতু বলল, “যেমন আপনার নিশ্বাসের শব্দ আমরা শুনতে পাচ্ছি। সেই শব্দ শুনে বুঝতে পারছি আপনার সাইজ পাহাড়ের মতো।”
“তাজ্জব ব্যাপার।”
মামুন বলল, “আপনার চেহারাটাও ভালো না।”
পাহাড়ের মতো মানুষটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল, “সেইটা তুমি কেমন করে বললে?”
মামুন উত্তর দেবার আগেই আঁখি বলল, “যে মানুষ যত সুন্দর করে কথা বলে তার চেহারা আমাদের কাছে তত সুন্দর মনে হয়। আপনি তো আমাদের সাথে সুন্দর করে কথা বলেন নাই।”
পাহাড়ের মতো মানুষটাকে কেমন জানি বিপর্যস্ত দেখাল। আমাদের স্কুলের গেট আসার আগে পর্যন্ত সেই মানুষটা আর একটা কথাও বলল না।
.
০৬.
যখন আমি বড় বড় গোঁফের একজন মুচির সাহায্যে ঝুনঝুন বল আবিষ্কার করলাম
ডাইনিং টেবিলে বসে খাচ্ছি তখন ভাইয়া জিজ্ঞেস করল, “তোদের ক্লাসের কানা মেয়েটার কী খবর?”
আমি প্রশ্নটা না শোনার ভান করে খেতে থাকলাম। ভাইয়া আবার জিজ্ঞেস করল, “কী হল? কথার উত্তর দিস না কেন?”
“কোন কথা?”
“কানা মেয়েটার কথা?”
“আমি কোনো কানা মেয়েকে চিনি না।”
“আমার সাথে ঢং করিস, তাই না?”
“আমি মোটেও ঢং করছি না।”
“তা হলে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিস না কেন?”
“তুমি সুন্দর করে প্রশ্ন কর আমি উত্তর দেব।”
ভাইয়া কেমন যেন খেপে উঠল, আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আম্মু দেখেছ, তিতা কেমন বেয়াদপ হয়ে উঠছে?”
আম্মু কিছু বলার আগেই আমি বললাম, ”আমার নাম তিতা না। আমার নাম তিতু।”
ফুলি খালা ডাল নিয়ে আসছিলেন, টেবিলে রেখে ভাইয়াকে বললেন, “মানুষের নাম নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করা ঠিক না। তিতু যখন পছন্দ করে না তখন তুমি কেন তারে তিতা ডাক?”
ভাইয়া ফুলি খালার ধমক খেয়ে কেমন যেন চিমসে গেল। আব্বু বললেন, “ফুলি ঠিকই বলেছে টিটু। তুমি তিতুকে কেন তিতা ডাক?”
আম্মু বললেন, “আর কখনো ডাকবে না।”
ভাইয়া তখন মুখটা গোঁজ করে খেতে লাগল। তখন আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “তোদের ক্লাসের ঐ মেয়েটা কেমন আছে?”
“আঁখি?”
“হ্যাঁ।”
“ভালো আছে। আমাদের পুরো ক্লাসকে জন্মদিনের দাওয়াত দিয়েছে।”
“পুরো ক্লাসকে?”
“হ্যাঁ।”
আম্মু বললেন, “খুব বড়লোক ফ্যামিলি?”
“মনে হয়।”
ভাইয়া মুখ বাঁকা করে বলল, “বড়লোক হয়ে লাভ কী? টাকা দিয়ে কি আর কানা চোখ ভালো করতে পারবে?”
আমি ভাইয়ার কথা না শোনার ভান করে আম্মুকে জিজ্ঞেস করলাম, “আঁখির জন্মদিনে কী উপহার দেওয়া যায় আম্মু?”
ভাইয়া বলল, “একটা লাঠি।” তারপর হা হা করে হাসতে লাগল যেন খুব মজার কথা বলেছে।
আম্মু বললেন, “অন্য বন্ধুদের কী দিস?”
“বই। গল্পের বই।”
আম্মু বললেন, “আঁখিকেও তাই দে।”
আব্বু বললেন, “বাসার কেউ একজন পড়ে শোনাবে।”
“কয়েকজন কী ঠিক করেছে জান?”
“কী?”
“একটা গল্পের বই না দিয়ে সেটা পড়ে রেকর্ড করে ক্যাসেটটা দিবে।”
আব্বু বললেন, “ভেরি গুড আইডিয়া। হাউ ক্লেভার।”
আম্মু বললেন, “অন্য কিছু না পেলে খাবার জিনিস দে। খাবার জিনিস সবাই পছন্দ করে।”
“উঁহু।” আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “নাহ্! আঁখি কিছু খেতে চায় না। তার টিফিনগুলো অন্যেরা ভাগাভাগি করে খেয়ে ফেলে।”
ভাইয়া বলল, “আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।”
আমি ভাইয়ার দিকে তাকালাম, “কী আইডিয়া?”
“একটা সুন্দর দেখে আয়না দে।” কথা শেষ করে আবার হা হা করে হাসতে লাগল, আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। ভাইয়া চোখের সামনে আস্তে ‘আস্তে কেমন যেন বোকা হয়ে যাচ্ছে। বেশি মুখস্থ করলেই মনে হয় মানুষ বোকা হয়ে যায়।
.
দুপুরবেলা আমরা স্কুলের মাঠে সাতচাড়া খেলছি-তখন হঠাৎ করে আমার মাথায় আইডিয়াটা এলো। অন্যান্য দিনের মতো আমরা দৌড়াদৌড়ি করছি, আঁখি বসে বসে আমাদের খেলাটা উপভোগ করছে। মামুন মাত্র চাড়াটা ভেঙে দৌড়াচ্ছে আমি বল দিয়ে তাকে মারার চেষ্টা করলাম, তাকে লাগাতে পারলাম না, বলটা আঁখির খুব কাছে ড্রপ খেয়ে তার কানের কাছে দিয়ে গেল, আঁখি তখন বলটা ধরার চেষ্টা করল। আরেকটু হলে ধরেই ফেলত–একটুর জন্যে পারল না। আঁখি না দেখেই বলটা প্রায় ধরে ফেলেছিল শব্দ শুনে। বলটা খুব কাছে ড্রপ খেয়েছে বলে সে শব্দটা শুনেছে। তার মানে যদি সবসময় বলটার ভিতরে একটা শব্দ হতে থাকে তা হলে আঁখি বলটা কোথায় বুঝতে পারবে। এরকম একটা বল যদি কিনতে পাওয়া যেত তা হলে আঁখিও আমাদের সাতে সাতচাড়া খেলতে পারত।
.
আর সেই বলটা হত আঁখির জন্যে একেবারে সত্যিকারের উপহার।
পরদিন আমি মার্কেটের দোকানগুলোতে গেলাম খোঁজ নেওয়ার জন্যে। আমার কথা শুনে তারা মনে হয় আকাশ থেকে পড়ল, অবাক হয়ে বলল, “বলের ভেতরে ঘণ্টা?”