আঁখি সবসময় সামনের বেঞ্চে বসত, আমি সবসময় বসতাম পিছনে। পিছনে বসলে স্যার-ম্যাডামের চোখের আড়ালে থাকা যায়, তাদের যখন হঠাৎ হঠাৎ প্রশ্ন করার ঝোঁক হয় তখন সামনের জনের পিছনে লুকিয়ে যাওয়া যায়। একদিন একটু আগে ক্লাসে এসে দেখি এর মাঝে আঁখি এসে তার জায়গায় বসে পা দুলাচ্ছে। আমি ঢুকতেই বলল, “তিতু, আজ এতো সকালে এসেছ?”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “তুমি কীভাবে বুঝলে আমি তিতু।”
আঁখি হাসল, “এটা হচ্ছে খোদার এক ধরনের খেলা–চোখে যখন দেখতে দিচ্ছি না তা হলে কানে বেশি করে শুনতে দেই।”
“কিন্তু আমি তো কোনো কথা বলি নাই।”
“তাতে কী হয়েছে! আমি পায়ের শব্দ শুনতে পাই। নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই।”
আমি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম, “তুমি আমার পায়ের শব্দ শুনে বুঝতে পেরেছ আমি কে?”
“হ্যাঁ তুমি যেভাবে শব্দ করে পা ঘষতে ঘষতে হাঁটো তোমার হাঁটার শব্দ শুনলে যে কেউ দুই মাইল দূর থেকে বুঝতে পারবে তুমি কে।”
আমি কখনো জানতাম না যে আমি শব্দ করে পা ঘষতে ঘষতে হাঁটি। আঁখি হাসি হাসি মুখ করে বলল, “পিছনে গিয়ে বসবে?”
“হ্যাঁ।”
“সাহসী বীর।”
“তুমি ভাবছ আমি সামনে বসতে ভয় পাই?”
“বসে দেখাও।”
কাজেই আমাকে সামনের বেঞ্চে বসতে হল। আমি আঁখির পাশেই বসলাম। আঁখির পাশে বসে আমি আবিষ্কার করলাম সে যদিও চোখে দেখতে পায় না কিন্তু কানে আশ্চর্য রকম সূক্ষ্ম শব্দ শুনতে পায়। যেরকম বজলু ক্লাসে ঢোকার অনেক আগেই সে বলল, “বজলু আসছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, “তুমি কেমন করে বুঝলে?”
“ওর জ্যামিতি বক্সটা ঝুনঝুন শব্দ করে।” আমি বজলুর পাশে থেকেও তার জ্যামিতি বক্সের ঝুনঝুন শব্দ শুনতে পেলাম না। যখন শান্তা ক্লাসে ঢুকল তখন আঁখি বলল, “শান্তা চুইংগাম খাচ্ছে।” মানুষ চুইংগাম খেলে যে শব্দ হয় আমি সেটাও আগে জানতাম না। আমি সবচেয়ে অবাক হলাম যখন তার সাথে কথা বলতে বলতে দেখলাম হঠাৎ তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”
“মা পাখিটা এসেছে।”
“মা পাখি? কোথায়?”
“আমি পিছনের জানালায় একটু চাল রেখেছি। মা পাখিটা তার বাচ্চাকাচ্চাকে নিয়ে সেগুলো খেতে এসেছে।”
“চাল? তুমি চাল এনেছ?”
“হ্যাঁ পাখির শব্দ শুনেছিলাম তো, তাই ব্যাগে করে প্রত্যেক দিন একটু চাল নিয়ে আসি। জানালার কাছে রাখি। একটা মা পাখি আর তার দুইটা বাচ্চা সেটা খেতে আসে।”
আমি আঁখির কথা বিশ্বাস করলাম না, তাই উঠে জানালার কাছে গিয়ে দেখতে হল, সত্যিই কয়েকটা পাখি কিচিরমিচির করছে। এর মাঝে কোনটা মা পাখি কোনটা বাচ্চাকাচ্চা পাখি বুঝতে পারলাম না। আমাকে দেখে পাখিগুলো শব্দ করে উড়ে গেল।
আমি যখন আঁখির কাছে ফিরে এলাম সে জানতে চাইল, “পাখিগুলো দেখতে কীরকম?”
“কালো রংয়ের। লম্বা লেজ।”
“বাচ্চাগুলো কত বড়?”
“কী জানি–কোনটা বাচ্চা কোনটা মা বুঝতে পারলাম না।”
“ঠোঁটগুলো কী রঙের?”
“খেয়াল করিনি।”
আঁখি তখন ছোট একটা নিশ্বাস ফেলল এবং আমি বুঝতে পারলাম আমি একটা জিনিস দেখেও সেটা লক্ষ করি না, আর বেচারি আঁখি সেটা কোনোদিন দেখতে পাবে না, আমার মুখ থেকে সেটা জেনেই সন্তুষ্ট হতে চায়। সেটাও আমি ঠিক করে করলাম না।
আমি তখন আঁখির এই নতুন ব্যাপারটা আবিষ্কার করলাম। শুধু শব্দ শুনে সে অনেক কিছু বুঝে ফেলে কিন্তু অনেক কিছু আছে যেগুলোর কোনো শব্দ নেই-আঁখি সেগুলোও জানতে চায়। নিজে থেকে সে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করে না, কিন্তু যদি তাকে বলা হয় সে খুব আগ্রহ নিয়ে শোনে। আমি যখন তার পাশে বসেছিলাম তখন বাংলা স্যার ঢোকার পর সে আমাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “আজকে কী রঙের কোট পরে এসেছেন?”
“সবুজ।”
“আজকেও সবুজ?”
“হ্যাঁ।”
“আহা বেচারা। একটা মাত্র কোট–তাও সবুজ রঙের।”
কিংবা যখন অঙ্ক ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকলেন তখন জিজ্ঞেস করল, “কী রঙের শাড়ি?”
আমি বললাম, “কী জানি। অনেক রকম রং আছে। ফুল টুল অনেক কিছু।”
“ব্লাউজটা কী রঙের?”
“বেগুনি। না কী নীল-”
“কপালে টিপ আছে?”
“নাই।”
“চশমা?”
“আছে।”
মাঝে মাঝে আমি নিজে থেকে তাকে কিছু কিছু জিনিস বলে দিই–যেরকম সমাজবিজ্ঞান ক্লাসে আমাদের কিছু একটা লিখতে দিয়ে যখন স্যার টেবিলে পা তুলে বসে রইলেন আমি আঁখিকে ফিসফিস করে বললাম, “এই যে স্যার এখন নাকের নোম ছেঁড়ার চেষ্টা করছেন। প্রথম চেষ্টা ফেইল। সেকেন্ড চেষ্টা–ওয়ান টু থ্রি পাস। লোমটা এখন খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করছেন। মুখে হাসি।” শুনে আঁখিও হাসে।
যখন ক্লাসের ফাঁকে ছেলেপিলেরা নিজেদের মতো বসে থাকে তখন আমিও সেটা আঁখিকে শোনালাম, “বজলু ডান হাতের কেনে আঙুল কানের ভিতরে ঢুকিয়ে চুলকাচ্ছে একশ মাইল স্পিডে শই শাঁই শাই–” কিংবা ”মামুন একটা হাই তুলেছে, বিশাল হাই আলজিহ্বা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে–” কিংবা, “শান্তা নিজের মনে মনে কথা বলছে, চোখ পাকালো আবার নরমাল আবার চোখ পাকালো–”
খুবই সাধারণ জিনিস কিন্তু আঁখি খুবই আগ্রহ নিয়ে শোনে! আঁখিকে বলতে গিয়ে আমিও আবিষ্কার করলাম আমাদের চারপাশে যা কিছু হতে থাকে সেগুলো খুবই সাধারণ কিন্তু ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যায় তার মাঝেই অসাধারণ ফাটাফাটি জিনিস লুকিয়ে আছে। যেমন ইংরেজি স্যারের ডান চোখটা যে মাঝে মাঝে চিড়িক চিড়িক করে নড়ে ওঠে সেটা আমি আগে কখনোই লক্ষ করিনি। আঁখি শোনার পর খুবই গম্ভীর হয়ে বলল, “এটার নাম টিক। নার্ভাস মানুষদের না কী এগুলো হয়।” আমি একবারও ভাবিনি আমাদের এতো গুরুগম্ভীর ইংরেজি স্যার আসলে নার্ভাস।