মেয়েটা হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু ছেলেমেয়েরা তাকে আটকে রাখল, রিতু বলল, “আমরা তোমাকে যেতে দেব না। তুমি কোনো চিন্তা কোরো না,
আমরা তোমার সবকিছুতে সাহায্য করব। তোমার কোনো সমস্যা হবে না।”
শান্তা বলল, “আমরা তোমার পাশে বসব, স্যারেরা বোর্ডে কিছু লিখলে সেটা তোমাকে পড়ে শোনাব।”
সুজন বলল, “পরীক্ষার সময় তুমি বলবে আমি লিখে দিব।”
মেয়েটা বলল, “কিন্তু আমি তো এখানে থাকতে পারি না।”
সবাই একসাথে চিৎকার করে বলল, “কেন? কেন পার না?”
“তোমরা তো জান কেন পারি না। তোমরা তো দেখেছ, শুনেছ। তোমরাই বল, এরপর আমি কি এখানে থাকতে পারি? থাকা উচিত?”
আমরা কী বলব বুঝতে পারলাম না। আমাদের মাঝে রিতু সবচেয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারে সবাই তার দিকে তাকালাম, তখন রিতু মেয়েটার হাত ধরে বলল, “কিন্তু তুমি আমাদের কথাটা একটু ভাববে না? তুমি যদি আজকে চলে যাও সারাটা জীবন আমাদের মনে কষ্ট থাকবে যে তোমার মতোন একটা সুইট মেয়েকে আমরা আমাদের ক্লাসে রাখতে পারিনি। বল, তুমি কি একজনের জন্যে আমাদের সবার মনে সারা জীবন কষ্ট দিবে? বল?”
মেয়েটা কোনো কথা বলল না। আমার মনে হল রিতুর পা ধরে সালাম করে ফেলি, রিতুর মতোন পুঁচকে একটা মেয়ে এতো সুন্দর করে কথা বলা শিখল কেমন করে? সুজন গলা নামিয়ে বলল, “দরকার হলে তুমি থাকবে। আমরা ঐ স্যারকে বিদায় করে দিব।”
অনেকেই সুজনের কথা শুনে মাথা নাড়ল, মাসুম বলল, “আমার কানের পর্দা ফাটিয়েছিলেন মনে নাই? এতোদিন কিছু বলি নাই, এখন দরকার হলে হাইকোর্টে মামলা করে দিব।”
বাংলা স্যার একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলেন আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছিলেন না, ঠিক কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। আমতা আমতা করে বললেন, “ইয়ে মানে তোমরা সবাই নিজের জায়গায় গিয়ে বস–”
আমরা নিজের জায়গায় বসার কোনো আগ্রহ দেখালাম না, মেয়েটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে লাগলাম। আমাদের ক্লাসের হট্টগোল শুনে পাশের ক্লাস থেকে স্যার আর ম্যাডামরা বের হয়ে এলেন, ছাত্রছাত্রীরা উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল। তখন রিতু আর শান্তা মেয়েটাকে দুই পাশ থেকে ধরে রীতিমতো টেনে ক্লাসের ভেতর ফিরিয়ে আনল।
বাংলা স্যার তার শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বললেন, “ব্যস অনেক হয়েছে। এখন সবাই চুপ কর। চুপ।”
আমরা চুপ করলাম না, ক্লাসের ভেতরে নিজেদের ভিতরে গুনগুন করে কথা বলতে লাগলাম। স্যার আবার দুর্বল গলায় বললেন, “চুপ।” কিন্তু কেউ চুপ করল না।
তখন রিতু উঠে দাঁড়াল, বলল, “স্যার।”
সাথে সাথে সারা ক্লাস চুপ করে গেল। স্যার একবার ঢোক গিলে বললেন, “কী হয়েছে?”
“আজকে আমাদের সাথে একজন নতুন ছাত্রী ভর্তি হয়েছে। স্যার সে মন খারাপ করে চলে যাচ্ছিল। আমরা অনেক কষ্ট করে তাকে ফিরিয়ে এনেছি।”
“তাতে কী হয়েছে?”
“আমরা চাই না সে মন খারাপ করে থাকুক।”
ক্লাসের অনেকেই মাথা নাড়ল। বলল, “জি স্যার, চাই না।”
“তা হলে কী করতে হবে?”
“আমরা স্যার নিরিবিলি তার সাথে কথা বলতে চাই।”
স্যার একবার ঢোক গিললেন, “নিরিবিলি?”
রিতু মাথা নাড়ল, বলল, “জি স্যার। আমরা আমরা নিজেরা। আপনি স্যার এই পিরিয়ডটা ছুটি দিয়ে দেন।”
“ছুটি?” স্যার চোখ কপালে তুলে বললেন, “ছুটি?”
আমরা সবাই বললাম, “জি স্যার ছুটি।”
স্যার এবারে কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন, তখন সুজন দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার আপনি যদি চান তা হলে আমরা হেড ম্যাডামের কাছ থেকে পারমিশান আনতে পারি। ক্লাসে কী হয়েছে সেটা বললেই ম্যাডাম নিশ্চয়ই রাজি হবেন–”
স্যার এবারে কেমন যেন খাবি খাওয়ার মতো ভান করলেন, বললেন, “না-না তার দরকার নাই। আ-আমি ছুটি দিচ্ছি। কিন্তু তোরা ক্লাসে কোনো গোলমাল করতে পারবি না।”
আমরা সবাই একসাথে চিৎকার করে প্রচণ্ড গোলমাল করে বললাম, “করব স্যার। গোলমাল করব না।”
স্যার হাত তুলে বললেন, “আস্তে আস্তে!” তারপর টেবিল থেকে রেজিস্টার খাতা, বই, চক আর ডাস্টার নিয়ে বের হয়ে গেলেন। আমরা তখন আরো একবার আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম।
স্যার ক্লাস থেকে বের হওয়া মাত্রই রিতু ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “সবাই চুপ। কোনো গোলমাল করবি না।”
আমরা এবারে চুপ করে বসে পড়লাম, রিতু তখন মেয়েটার কাছে গিয়ে তার হাত ধরে সামনে নিয়ে আসে। তারপর বক্তৃতার ভঙ্গিতে বলল, “প্রিয় ভাই ও বোনেরা। আজকে আমাদের সাথে একজন নতুন ছাত্রী পড়তে এসেছে। আরেকটু হলে সে মন খারাপ করে চলে যাচ্ছিল। আমরা অনেক কষ্ট করে তাকে ফিরিয়ে এনেছি। আমরা এখন আমাদের এই নতুন বন্ধুকে আমাদের উদ্দেশে কিছু বলতে বলব।”
মেয়েটা কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল, বলল, “বলব? আমি?”
‘“হ্যাঁ।”
“কী বলব?”
“তোমার যেটা ইচ্ছা।”
“আমি কখনো এভাবে কিছু বলি নাই। আমি কিছু বলতে পারব না।”
“পারবে। পারবে।” আমরা টেবিলে থাবা দিয়ে বললাম, “শুরু কর।”
মেয়েটা একটু ইতস্তত করে তখন শুরু করল, “ইয়ে মানে আমার নাম হচ্ছে–মাইশা হাসান। আমার ডাকনাম হচ্ছে আঁখি।” মেয়েটা একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, “আঁখি মানে হচ্ছে চোখ। আমার আব্লু-আম্মু যদি আগে জানত তা হলে আমার মনে হয় কখনোই আমার নাম আঁখি রাখত না। অন্য কিছু রাখত।”