টুশির কথা বলার ইচ্ছে নেই তাই সে চুপ করে বসে রইল, অনেকে বলল, “চুম্বক লোহাকে আকর্ষণ করে আপা।”
“হ্যাঁ। চুম্বক লোহাকে আকর্ষণ করে।” রেহানা আপা মাথা নেড়ে বললেন, “চুম্বক কি কাঠকে আকর্ষণ করে?”
ফারিয়া সবার চেয়ে জোরে চিৎকার করে বলল, “না আপা করে না।”
“ভেরি গুড–”
রেহানা আপা আরও কিছু কথা বললেন কিন্তু টুশি তার কিছু শুনতে পেল না, কারণ সে বিস্ফারিত চোখে দেখল ঠিক তখন কাবিল কোহকাফী হেলতে দুলতে ঢুকছে, টুশিকে দেখে সে চোখ টিপে হাত নাড়াল। টুশি মুখ শক্ত করে চোখের ইশারায় কাবিলকে সরে যেতে বলল–কাবিল সেই ইশারাকে একেবারে কোনো পাত্তা না দিয়ে রেহানা আপার টেবিলের একেবারে কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তার চোখেমুখে একধরনের আনন্দের ভাব যেটা টুশির একেবারেই পছন্দ হল না।
রেহানা আপা চুম্বকটা হাতে নিয়ে বললেন, “এই চুম্বকটা কাঁচকে আকর্ষণ করে, কাঠকে আকর্ষণ করে না, ডাস্টারকে আকর্ষণ করে না, চককে আকর্ষণ করে না–শুধু লোহাকে আকর্ষণ করে। এই দ্যাখো–”
বলে রেহানা আপা চুম্বকটা একটা চকের কাছে ধরতেই সবাই অবাক হয়ে দেখল চকটা লাফ দিয়ে চুম্বকের গায়ে লেগে গেল–আসল কারণটা দেখতে পেল শুধু টুশি–কাবিল কোহকাফী চকটাকে টান দিয়ে নিয়ে এসেছে, অন্য সবাই বিস্ময়ের একটা শব্দ করল।
রেহানা আপা কেমন যেন ঘাবড়ে গেলেন। তিনি ভয়ে ভয়ে চুম্বকটা আবার কয়েকটা চকের কাছে ধরতেই চকগুলো জীবন্ত প্রাণীর মতো তার উপর লাফিয়ে পড়ল। রেহানা আপা ভয় পেয়ে চুম্বকটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে দূরে সরে গেলেন। সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল, শুধু ফারিয়া হি হি করে হেসে বলল, “খুব শক্তিশালী চুম্বক তাই না আপা? চককেও আকষর্ণ করে।”
রেহানা আপা কোনো কথা না বলে চুম্বকটা হাতে নিতেই টেবিলের উপর রাখা পানির বিকারটা চুম্বকের আকর্ষণে সেটার দিকে ছুটে গেল এবং সেই পানি ছিটকে রেহানা আপাকে ভিজিয়ে দিল। রেহানা আপা চিৎকার করে পিছনে সরে গিয়ে ভয় পেয়ে চুম্বকটা হাত থেকে ফেলে দিরেন। ক্লাসের কেউ কোনো কথা বলল না, শুধু ফারিয়া বলল, “খুব শক্তিশালী চুম্বক তাই না আপা? পানিকেও আকর্ষণ করে।”
টুশি নিচু গলায় বলল, “চুম্বক পানিকে আকর্ষণ করে না গাধা।”
“এই যে করল!”
“করে নাই। অন্য কিছু হয়েছে।”
ফারিয়া তখন রেহানা আপাকে নালিশ করে নেকু নেকু গলায় বলল, “দেখেছেন আপা কী বলছে!”
রেহানা আপা তখনও চুম্বকটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, ঢোক গিলে বললেন, “কী বলেছে?”
“বলেছে চুম্বক নাকি পানিকে আকর্ষণ করে না। খুব শক্তিশালী চুম্বক হলে করে। তাই না আপা?”
রেহানা আপা শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের শরীর মুছতে মুছতে বললেন, “ইয়ে মানে সাধারণত করে না, কিন্তু আজকে মানে ইয়ে মনে হচ্ছে–” রেহানা আপা থেমে গিয়ে বললেন, “চুম্বকটা থাক। তোমাদের বরং অন্য একটা এক্সপেরিমেন্ট করে দেখাই।” রেহানা আপা টেবিলের ওপর রাখা স্ট্যান্ড থেকে ঝুলে থাকা পেন্ডুলামটা দেখিয়ে বললেন, “এই যে এটা হচ্ছে একটা পেন্ডুলাম। এটা দুলিয়ে দিলে কী হবে?”
ক্লাসের অফিসিয়াল ভালো ছেলে জাবেদ বলল, “এর দোলনকাল হবে দৈর্ঘ্যের বর্গমূলের সমানুপাতিক।”
রেহানা আপা মাথা নাড়লেন, খুব অনিচ্ছার সাথে বললেন “গুড।” ফারিয়া ছাড়া আর কারও উত্তর বা কথাবার্তা তার ভালো লাগে না। তিনি পেন্ডুলামটা ধরে একপাশে টেনে এনে বললেন, “এই যে পেন্ডুলামটা আমি একপাশে টেনে এনে ছেড়ে দিচ্ছি দেখবে এটা দুলতে থাকবে ডান থেকে বামে, বাম থেকে ডানে। সমানতালে। এই দ্যাখো–”
রেহানা আপা পেন্ডুলামটা ছাড়লেন সেটা দুলে অন্য পাশে যেতেই কাবিল কোহকাফী সেটা খপ করে ধরে ফেলল। ক্লাসের সবাই এবং রেহানা আপা বিস্ফারিত চোখে দেখলেন পেন্ডুলামটা অন্য পাশে গিয়ে আটকে গেছে, সেটা আর নড়ছে না। ফারিয়ার চোখ আনন্দে ঝলমল করতে থাকে, সে হাত নেড়ে বলল, “পেন্ডুলামটা বেশি ভারী দেখে আটকে গেছে আর নড়ছে না, তাই না আপা?”
রেহানা আপা কোনো কথা না বলে পেন্ডুলামটা ধরতে গেলেন ঠিক তখন সেটা তাঁর হাত গলে উপরে উঠে গেল। রেহানা আপা কিছুক্ষণ হাঁ করে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর পেন্ডুলামটা ধরতে গেলেন তখন সেটা কেমন যেন নাচের ভঙ্গিতে লাফাতে লাগল এবং সেটা দেখে ফ্যাকাশে ভঙ্গিতে রেহানা আপা এক লাফে পিছনে সরে গেলেন।
টুশি দেখল কাবিল কোহকাফী পেন্ডুলামটা ছেড়ে দিয়ে আনন্দে হাসতে হাসতে একপাশে সরে দাঁড়িয়েছে। সে চোখের ইশারায় তাকে নিষেধ করার চেষ্টা করল কিন্তু কাবিল কোহকাফী ভ্রূক্ষেপ করল না।
পেন্ডুলামটা থামার পর রেহানা আপা খানিকক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “পেন্ডুলামটাও থাকুক। তোমাদের তাপ নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করে দেখাই।”
টুসি একধরনের আতঙ্ক নিয়ে দেখল কাবিল কোহকাফী একগাল হেসে এক্সপেরিমেন্ট দেখার জন্যে এগিয়ে এল।
রেহানা আপা একটা মোমবাতি টেবিলে বসিয়ে মোমবাতিটি জ্বালালেন, কাবিল সাথে সাথে ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটি নিভিয়ে দিল। রেহানা আপা আবার জ্বালালেন, কাবিল কোহকাফী আবার নিভিয়ে দিল। রেহানা আপা একটু বিরক্ত হয়ে এবারে হাত দিয়ে আড়াল করে একটু সাবধানে মোমবাতিটি জ্বালালেন। মোমবাতিটি ঠিকভাবে জ্বলা পর্যন্ত কাবিল কোহকাফী অপেক্ষা করল, তারপর ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল। রেহানা আপা একটু অবাক হয়ে এদিক-সেদিক তাকালেন, ওপরে তাকালেন তারপর আবার জ্বালালেন। মোমবাতিটি যখন স্থির হয়ে জ্বলতে লাগল তখন কাবিল কোহকাফী ফুঁ দিয়ে সেটাকে নিভিয়ে দিল।