“ছোট করেই এই! নাম হতে হয় দুই শব্দের তা হলে বলা যায়, মনে রাখা যায়।
“ঠিক আছে বাবা ঠিক আছে। আরও ছোট করে দিই।” জিনটা বিরক্ত হয়ে বলল, “কাবিল কোহকাফী। হয়েছে?”
“হয়েছে। কাবিল কোহকাফী।”
“এখন বকবক না করে পিঠটা ডলে দাও। আচ্ছা করে মালিশ করে দাও। যা টাটাচ্ছে সেটা আর বলার মতো না । ভেড়ার চর্বি গরম করে তার মাঝে দুই ফোঁটা তাৰ্পিন দাও। সেখানে এক রতি কর্পূর আর ধানকুচি পাতার রস।”
টুশি চোখ কপালে তুলে বলল, “এইসব আমি কোথায় পাব?”
তপু এতক্ষণ একটা কথাও বলে নি, এবারে সাহস করে বলল, “আ-আ আব্দুর পা ম-ম-মচকে গিয়েছিল। তখন একটা ম-ম-মলম লাগিয়েছিল। সে-সে সেটা দিয়ে হবে?”
টুশি মাথা নাড়ল, বলল, “হবে। কোথায় আছে?”
“ড-ড-ড্রয়ারের মাঝে।”
“যা নিয়ে আয়।”
.
একটু পর টুশি সাবধানে কাবিল কোহকাফীর পিঠে সেই ঝাঁঝালো গন্ধের মলম ডলে দিতে থাকে। কাবিলের চোখ আরামে বন্ধ হয়ে আসে, মুখে বলতে থাকে, “আ-হা-হা-! উ-ম-ম-ম-ম! আ-আ-আ–।”
টুশিকে দেখে সাহস পেয়ে তপুও এগিয়ে আসে, সেও টুশির সাথে হাত লাগায় এবং কিছুক্ষণের মাঝে কাবিল কোহকাফী সোজা হয়ে সোফার মাঝে উঠে বসে। দুই হাত উপরে তুলে একটা হুংকার দিয়ে হঠাৎ করে সে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, ভয়ে আতঙ্কে টুশি আর তপু ছিটকে সরে গেল। তারা ভয় পাচ্ছিল কাবিল কোহকাফী বুঝি তরবারিটি তুলে নিয়ে তাদের দিকে তেড়ে আসবে, কিন্তু সেরকম কিছু হল না। কাবিল কোহকাফী তার বুকে থাবা দিয়ে হঠাৎ করে বিকট গলায় গান গাইতে শুরু করে,
“শাহাজাদী দুনিয়া পেয়ারের মুনিয়া
বুক ভেঙে কই গেলি খুনিয়া
কলিজার টুকরা
ছাতিনার হাড়ি
বাগদাদি কুকরা
ওরে ও শাজহাদী দুনিয়া আ-আ-আ-”
কাবিল কোহকাফী ঘরের মাঝে ঘুরে ঘুরে গান গাইতে গাইতে হঠাৎ করে থেমে গিয়ে টুশি আর তপুর দিকে তাকাল, তারপর পেটে হাত দিয়ে বলল, “খিদে লেগেছে।”
টুশি বলল, “খিদে?”
কাবিল কোহকাফী মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। এক হাজার বছর কিছু খাই নাই, মনে হচ্ছে তোমাদের দুইজনকে ধরে কচমচ করে খেয়ে ফেলি!”
“আ-আমাদের?” টুশি এক লাফে দুই পা পিছিয়ে গেল, তপু তার চাইতেও বড় লাফ দিয়ে টুশির পিছনে লুকিয়ে গেল।
কাবিল হাত নেড়ে বলল, “জলদি জলদি খানা লাগাও। শিক কাবাব, বোখরা মিঠাই, তন্দুরি রুটি, বেদানার রস–”
টুশি ঢোক গিলে বলল, “আ-আসলে তো বাসায় খাবার তো সেরকম নেই। একটা বিস্কুটের প্যাকেট–”।
তপু বাধা দিয়ে বলল, “টু-টু-টুশি আপু। খি-খি-খিচুড়িটা দিয়ে দাও।”
“ও হ্যাঁ।” টুশি মাথা নাড়ল, “একটু খিচুড়ি আছে। তুমি খাবে?”
“খিচুড়ি ঘিচুড়ি ফিচুড়ি মিচুড়ি যা আছে তাই নিয়ে আসো। যত খিদে লেগেছে আস্ত একটা ঘোড়া খেয়ে ফেলতে পারি।”
টুশি দৌড়ে ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গেল, পিছুপিছু কাবিল কোহকাফী ছুটে আসে। ফ্রিজটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, “এইটা কিসের বাক্স?”
“এইটা বাক্স না। এইটার নাম ফ্রিজ। এর ভিতরে খাবার রাখে।” টুশি ফ্রিজের দরজা খুলে খিচুড়ির বড় ডেকচিটা টেনে বের করে এনে ডাইনিং টেবিলের উপরে রাখল। কাবিল ঢাকনা খুলে উল্লসিত চোখে বলল, “মারহাবা! মারহাবা।” হঠাৎ করে ফ্রিজের ভিতরে কাবিল কোহকাফীর চোখ পড়ল, ফ্রিজের দরজায় সাজানো ডিমগুলো দেখে তার চোখ গোল গোল হয়ে ওঠে, চিৎকার দিয়ে বলল, “ডিম! ডিম! ডিম! আহাহা কত দিন ডিম দেখি নাই” সে খাবলা দিয়ে একটা ডিম হাতে নিয়ে সেটাকে চুমো খেতে থাকে।
টুশি বলল, “তোমার ডিম খেতে ভালো লাগে?”
“ডিম আমার জান।” কাবিল কোহকাফী হাত ছড়িয়ে বলল, “ডিম আমার প্রাণ। ডিম আমার চানকে চান, মানকে মান।”
“তোমাকে একটা ডিম ভাজা করে দেব?”
“ভাজা করে ভালো একটা ডিমকে তুমি নষ্ট করতে চাও?” বলে কাবিল কোহকাফী আস্ত একটা ডিম ভেঙে কোঁৎ করে পুরোটা খেয়ে ফেলল।
সুমি কিংবা অপু এর আগে কখনও কাউকে কাঁচা ডিম খেতে দেখে নি, কাবিলকে এভাবে একটা কাঁচা ডিম গিলে ফেলতে দেখে তাদের গা গুলিয়ে আসে।
কাবিল কোহকাফী সবগুলো ডিম কোলে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের উপর লাফ দিয়ে উঠে বসল–চেয়ারে বসে যে খেতে হয় ব্যাপারটা সে মনে হয় জানেই না। তার ভারী শরীরের ওজনে মনে হল পুরো টেবিলটা মট মট করে ভেঙে পড়বে– কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়ল না। কাবিল একহাত দিয়ে এক খাবলা খিচুড়ি নিয়ে মুখে পারে, অন্য হাত দিয়ে একটা ডিম ভেঙে তার শাস কুসুম মুখে ঢেলে দিয়ে হুম হাম শব্দ করে খেতে থাকে। সারা মুখ থেকে খাবার ছিটকে পড়তে থাকে– তার গোঁফদাড়িতে খিচুড়ি ডিম লেগে কিছুক্ষণেই তার চেহারা কিম্ভুতকিমাকার হয়ে যায়।
টুশি আর তপু একটা বিস্ময় নিয়ে কাবিল কোহকাফীর দিকে তাকিয়ে থাকে। এর আগে তারা কখনওই একজন মানুষকে এত তৃপ্তি নিয়ে কিছু খেতে দেখে নি। এক হাজার বছর না খেয়ে থাকলেই বুঝি শুধু মানুষ এত তৃপ্তি করে কিছু খেতে পারে। যে খিচুড়িটুকু আগামী এক সপ্তাহে সবাই মিলে খেয়ে শেষ করতে পারবে বলে মনে হয় নি কাবিল কোহকাফী একবারে সেটা চেটেপুটে খেয়ে বিশাল একটি ঢেকুর তুলল।
টুশি জিজ্ঞেস করল, “তোমার পেট ভরেছে?”
কাবিল কোহকাফী তার বড় পেটে হাত বুলিয়ে বলল, “আপাতত। ফাসক্লাস রান্না। শাহজাদি দুনিয়ার বাবুর্চিও এত ভালো রান্না করতে পারত না। আর তিতির পাখির ডিমগুলিও একেবারে অমৃত–”।