দিনটা সুন্দরভাবে শুরু হয়েছে। আকাশে ঝকঝকে রোদ। বাতাস মধুর শীতল। রাতে বৃষ্টি পাওয়ায় গাছপালার পাতা চকচক করছে। ধূলি-শূন্য শহর। জয়নাল ঠিক করে রেখেছে মন খারাপ হবার সামান্যতম সম্ভাবনা আছে এরকম কোনো কাজ সে করবে না। আজ তার জীবনের একটি বিশেষ দিন। ইতি নামের অসাধারণ একটি মেয়ের সঙ্গে তার এনগেজমেন্ট। বিয়ে হয়ে যাবার সম্ভাবনাও আছে। মন খারাপ হতে পারে এমন কোনো ঘটনা ঘটিয়ে আজকের দিনটা সে নষ্ট হতে দিতে পারে না।
দুপুর পর্যন্ত জয়নাল নিজের ঘরে বসে রইল। বিয়ের দিন বর-কনে দুজনকেই ঘরে বন্দি থাকতে হয়। রাস্তায় বের হওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রাস্তায় বের হলে একসিডেন্ট হতে পারে। কোনোরকম রিস্ক নেওয়া যাবে না।
ডাকে তিনটা চিঠি এসেছে। জয়নাল চিঠিগুলো পড়ল না। চিঠিতে মন খারাপ হবার মতো কিছু থাকতে পারে। মন ভালো হয়ে যেতে পারে এমন চিঠি জয়নালকে অনেকদিন কেউ লিখে নি। বেছে বেছে আজকের দিনে লিখবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। চিঠি মানেই দুঃসংবাদ। আজকের দিনটা থাকুক দুঃসংবাদের ঊর্ধ্বে।
দুপরে জয়নাল হোটেল থেকে খাবার এনে খেল। চুলা ধরিয়ে নিজে বান্নী করল না। বিয়ের আগের দিন মেয়েদের রান্না করতে দেয়া হয় না। মেয়েদের জন্য যে নিয়ম ছেলেদের জন্যেও তো সেই নিয়মই হওয়া উচিত।
ইতিদের বাড়িতে যাবার কথা সন্ধ্যাবেলা। মাগরেবের পর। শামসুদ্দিন সাহেবকে খবর দেয়া আছে। সন্ধ্যা ছটার সময় সে শামসুদ্দিন সাহেবের বাসায় চলে যাবে। সাড়ে ছটার দিকে বের হবে। সঙ্গে গাড়ি থাকলে ভালো হতো। কনের বাড়িতে বর যাবে বেবিটেক্সিতে, ভাবতেই যেন কেমন লাগে। যে মেয়েটির বিয়ে হচ্ছে তারও মানসম্মানের ব্যাপার আছে। জয়নাল ভেবেছিল তিন-চার ঘণ্টার জন্যে একটা প্রাইভেট কার বা মাইক্রোবাস ভাড়া করবে। সেটা সম্ভব হয় নি। দুহাজার টাকা ভাড়া চায়। বেবিটেক্সিতে করে গেলে যেতে আসতে লাগবে আশি টাকা। কোথায় আশি টাকা আর কোথায় দুহাজার টাকা। কোনো মানে হয় না।
জয়নাল ঘর থেকে বের হলো বিকেল তিনটায়। এত আগে বের হওয়া খুবই বোকামি হয়েছে। একা ঘরে বসে থাকতে মন চাইছে না। এখন সমস্যা হয়েছে সময় কাটানো। শামসুদ্দিন সাহেবের কাছে বিকেল তিনটা থেকে বসে থাকতে লজ্জা লাগছে। তিনি হয়তো মনে মনে ভাববেন ব্যাটার দেরি সহ্য হচ্ছে না। যাবে মাগরেবের পর সে এসে বসে আছে দুপুর থেকে।
সময় কাটানোর জন্যে জয়নাল ঢুকে পড়ল কার হেভেন নামের এক গাড়ির দোকানে। সুন্দর সুন্দর ঝকঝকে গাড়ি পড়ে আছে। গাড়িগুলো দেখার মধ্যেও অনিন্দ। জয়নাল এমন ভাব করল যেন সে গাড়ি কিনতে এসেছে। আজ ব্যাপারটা খুব হাস্যকর লাগলেও একদিন সে নিশ্চয়ই গাড়ি কিনবে। দোকানের একজন কর্মচারী চোখ সরু করে তাকাচ্ছে। এমন সরু চোখে তাকানোর কিছু নেই। তোমরা গাড়ি সাজিয়ে রেখেছ মানুষকে দেখানোর জন্যেই। জয়নাল প্রাণপণ চেষ্টা করছে এমন একটা ভঙ্গি করতে যেন সে গাড়ি কিনতেই এসেছে। যারা গাড়ি কিনতে আসে তারা নিশ্চয়ই বিশেষ ধরনের কোনো কাপড় পরে আসে না। তার মতোই শার্ট প্যান্ট পরে আসে। কথাও নিশ্চয়ই সাধারণ মানুষের মতোই বলে।
আপনি কী চান?
কর্মচারীর কথা শুনেই জয়নালের গা জ্বলে গেল। কথা বলার ধরন কী? আপনি কী চান?
জয়নাল গম্ভীর গলায় বলল, কিছু চাই না। গাড়ি দেখছি। জীবনে কখনো কাছ থেকে গাড়ি দেখি নি। এখন কাছ থেকে দেখছি। দুএকটা গাড়ি হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখব। কোনো সমস্যা আছে? সমস্যা থাকলে বলুন অন্য কোনো গাড়ির শো-রুমে যাই।
কর্মচারী হকচকিয়ে গেল। সে সঙ্গে সঙ্গে বিনীত সুর বের করে বলল, স্যার বলুন কী গাড়ি দেখবেন?
আপনাদের কি সবই রি-কন্ডিশন্ড গাড়ি?
জি স্যার।
নাইনটি নাইন মডেলের নোয়া আছে?
একটা আছে।
দাম কত?
পনেরো লাখ।
নাইনটি নাইন মডেলের নোয়ার দাম তেরো লাখের বেশি হবার পেছনে কোনো যুক্তি আছে?
গাড়িতে ভিসিডি প্লেয়ার আছে। সিডি আছে। সান রুফ আছে, মুন রুফ আছে। পেছনে সিঁড়ি আছে। সিঁড়িটার দামই স্যার পড়ে পঞ্চাশ হাজার।
সিঁড়ি তো কোনো কাজের সিঁড়ি না। শো পিস।
জি স্যার, শো পিস।
লুসিডা আছে?
একটা আছে নীল।
কোন মডেল?
৯৮ মডেল।
দাম বলুন।
এগারো লাখ।
আপনি তো এখানকার কর্মচারী?
জি স্যার।
মালিকপক্ষের কেউ কি আছে?
জি স্যার, আছে, আমি নিয়ে আসি। আপনি কি চা কফি কিছু খাবেন?
চা কফি কিছুই খাব না। মালিকপক্ষের কেউ থাকলে তাকে ডাকুন।
কার হেভেনের মালিক আব্দুর রহমানের সঙ্গে খুবই সহজ ভঙ্গিতে জয়নাল কথা বলল। নিজের কথায় জয়নাল নিজেই মুগ্ধ। এক সময় তার মনে হতে লাগল আসিলেই সে গাড়ি কিনতে এসেছে।
আব্দুর রহমান সাহেব, আপনাকে আসল কথা বলি–আগামী মাসের ১১ তারিখ আমার স্ত্রীর জন্মদিন। অনেক আগে তাকে প্রমিজ করেছিলাম তার জন্মদিনে একটা ব্র্যান্ড নিউ লাক্সারি মাইক্রোবাস দেব। ব্র্যান্ড নিউ লাক্সারি মাইক্রোবাস আমি কিনতে চাচ্ছি না। রি-কন্ডিশন গাড়িই কিনব। কিন্তু গাড়ির লুক ভালো হতে হবে। গাড়িতে সান রুফ মুন রুফ আমার কাছে খুবই হাস্যকর লাগে। কিন্তু আমার স্ত্রীর আবার এইসব পছন্দ। এখন আপনাকে আমি খোলাখুলি কয়েকটা ব্যাপার বলি–আমার স্ত্রী গেজেটের ভক্ত। গাড়িতে যত বেশি গেজেটস থাকবে তত সে খুশি। তার প্রিয় রঙ নীল। আমার বাজেটটাও বলি। বাজেট দশ লাখ। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ফি-ও তার মধ্যে ইনক্লুডেড।