শামসুদ্দিন দেখলেন রাহেলার চোখ চকচক করছে। সে মনে হচ্ছে এখনই কেঁদে ফেলবে। শামসুদ্দিনের মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
পৃথুকে দোকানে নিয়ে গিয়ে শামসুদ্দিন একটা ফুটবল কিনে দিলেন। পৃথু হতভম্ব হয়ে গেল। শবেবরাতে আল্লাহর কাছে তো সে ফুটবলই চেয়েছিল। যা সে চেয়েছিল তাই তো পাচ্ছে। তবে ফুটবলের সঙ্গে সে একটা পাম্পারও চেয়েছিল। পাম্পারটা পাওয়া যায় নি।
শামসুদ্দিন বললেন, আর কী লাগবে বল।
পৃথু লজ্জিত গলায় বলল, আর কিছু লাগবে না।
লজ্জা করিস না, বল।
একটা পেনসিল-বক্স কিনব–ডোনাল ডাকের ছবিওয়ালা।
এই দোকানে সে-রকম পেনসিল-বক্স ছিল না। শামসুদ্দিন চার-পাঁচটা দোকান ঘুরে পৃথুর পছন্দের পেনসিল-বক্স কিনলেন। আশ্চর্য ব্যাপার, বেনানা ইরেজারও পাওয়া গেল। শামসুদ্দিন বললেন, আয় তোকে লাল টুকটুক একটা গেঞ্জি কিনে দিই।
গেঞ্জি কিনব না মামা। ফুলপ্যান্ট কিনব। হাঁটুর কাছে জিপার থাকে। জিপার খুললে ফুলপ্যান্টটা হাফপ্যান্ট হয়ে যায়।
কোথায় পাওয়া যায়?
কোথায় পাওয়া যায় আমি জানি না।
আয় খুঁজতে থাকি। কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। তুই টায়ার্ড না তো?
না।
বিশেষ ধরনের প্যান্ট শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল। পৃথুর এত অবাক লাগছে! শবেবরাতে আল্লাহর কাছে যা যা চাওয়া হয়েছে সবই পাওয়া গেছে, শুধু লাল রঙের পাজেরো জিপটা এখনো পাওয়া যায় নি। তবে পাওয়া নিশ্চয়ই যাবে।
রাতে ঘুমোতে যাবার সময় রফিক বলল, রাহেলা তুমি কি গায়ে সেন্ট মেখেছ। নাকি? মিষ্টি গন্ধ আসছে।
রাহেলা বলল, গা থেকে মিষ্টি গন্ধ এলে কি তোমার ঘুমের অসুবিধা হবে? অসুবিধা হলে গরম পানি দিয়ে গোসল করে আসি।
রফিক বলল, খুবই মিষ্টি গন্ধ। সেন্ট কবে কিনলে? নাকি কেউ উপহার দিয়েছে?
এত কিছু বলতে পারব না। গন্ধটা ভালো লাগছে?
হ্যাঁ।
আমার কাছে আরেকটা সেন্ট আছে, সেটার গন্ধ এটার চেয়েও ভালো।
বলো কী।
দুটা সেন্টই আমাকে একজন উপহার দিয়েছে।
কে দিয়েছে? ভাইজান দিয়েছেন নাকি?
ভাইজান আমাকে সেন্ট দেবেন কেন? আমি কি ভাইজানের প্রেমিকা? হুট করে তুমি ভাইজানকে সন্দেহ করে ফেললে। তোমার লজ্জাও করল না? খালাতো ভাই হলেও তো সে ভাই।
সরি।
সেন্ট দুটা আমি নিজের টাকায় কিনেছি। কিছু প্রাইজবন্ড ছিল। প্রাইজবন্ড বিক্রি করে কিনেছি।
ভালো করেছ।
রাহেলা বিছানায় উঠে বসে উৎসাহের সঙ্গে বলল, আমার ঐ সেন্টের গন্ধটা শুঁকে দেখতে চাও?
রফিক বলল, অবশ্যই চাই। এক কাজ কর, আমার শার্টে খানিকটা স্প্রে করে দাও।
বোকার মতো কথা বলবে না, মেয়েদের সেন্ট তোমার গায়ে স্প্রে করব কেন? এত দামী একটা জিনিস খামাখা নষ্ট হবে।
তাহলে থাক।
রাহেলা সেন্টের শিশি বের করে নিয়ে এলো এবং রফিককে বিস্মিত করে তার শার্টে স্প্রে করে দিল। অনেক অনেক দিন পর রাহেলা ঘুমুতে যাবার সময় স্বামীর গায়ে হাত রাখল।
দুঃস্বপ্ন দেখে জয়নালের ঘুম ভেঙেছে
দুঃস্বপ্ন দেখে জয়নালের ঘুম ভেঙেছে। সে বিছানায় জবুথবু হয়ে বসে আছে। টিনের চালে ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টিভেজা ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। ব্যাঙ ডাকছে। রীতিমতো বর্ষা-পরিবেশ।
জয়নাল ঘড়ি দেখল, তিনটা সাত বাজে। পানি খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়া যায়। গায়ে চাদর দিয়ে শুয়ে পড়লে আরামের ঘুম হবে। তার ঘুমোতে যেতে ইচ্ছা করছে না। বরং বৃষ্টির শব্দ শুনতে ইচ্ছা করছে। আমেরিকায় টিনের চালের বৃষ্টি, বৃষ্টির সঙ্গে ব্যাঙের ডাক শোনা যাবে না। একেকটা দেশ একেক রকম। বাংলাদেশ বৃষ্টির দেশ। সকালের বৃষ্টি এক রকম, দুপুরের বৃষ্টি আরেক রকম, আবার নিশিরাতের বৃষ্টি সম্পূর্ণ অন্যরকম। একটা ক্যাসেটে বৃষ্টির শব্দ রেকর্ড করে নিয়ে গেলে কেমন হয়? আমেরিকায় পৌছানোর পর দেশের জন্যে যদি খুব মন খারাপ লাগে তাহলে ক্যাসেট বাজিয়ে শোনা হবে। ঘটনাটা হয়তো এরকম ঘটবে–সে এবং ইতি ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে রকিং চেয়ারে দোল খাচ্ছে। দুজনের হাতেই কফির মগ। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কারণ বাইরে প্রচণ্ড তুষারপতি হচ্ছে। তাপমাত্রা নেমে গেছে শূন্যের অনেক নিচে। তবে ঘরের ভেতরে ফায়ারপ্লেসের কারণে আরামদায়ক উষ্ণতা? সেই উষ্ণতায় আরামে হাত-পা ছেড়ে তারা দুজন শুনছে বাংলাদেশের বৃষ্টির ক্যাসেট-করা শব্দ। জয়নাল ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। শেষ পর্যন্ত আমেরিকা যাওয়া হবে তো?
দুঃস্বপ্নটা না যাওয়া বিষয়ক। স্বপ্নের শুরুটা ছিল সুন্দর। শুরুটা সুখ-স্বপ্নের। কিছুদূর গিয়েই সুখ-স্বপ্নটা হঠাৎ এবাউট টার্ন করে দুঃস্বপ্ন হয়ে যায়। স্বপ্নের শুরুতে দেখা যায় তারা তিনজন আমেরিকায় যাবার জন্যে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হয়েছে। সে, শামসুদ্দিন সাহেব এবং ইতি। মালপত্র মাইক্রোবাসে তোলা হচ্ছে। শামসুদ্দিন সাহেব ইতিকে বৌমা বৌমা বলে ডাকছেন। মাইক্রোবাসে উঠে শামসুদ্দিন সাহেব বললেন, বৌমা, একটা পান খাওয়াও তো দেখি, বাংলাদেশে শেষ পানটা খেয়ে যাই। ইতি তাকে একটা পান দিল। তখন জয়নাল বলল, দেখি আমাকেও একটা পান দাও। ইতি পান বানিয়ে জয়নালের হাতে না দিয়ে সরাসরি মুখে ঢুকিয়ে দিল। খুবই অস্বস্তিকর ব্যাপার। শামসুদ্দিন সাহেব আড়চোখে ঘটনাটা দেখলেন। মাইক্রোবাসের ড্রাইভারও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। স্বপ্নটা এই পর্যন্ত সুখ-স্বপ্ন। এয়ারপোর্ট পৌঁছেই স্বপ্নটা হয়ে গেল দুঃস্বপ্ন। ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। শামসুদ্দিন সাহেব এবং ইতি ইমিগ্রেশন পার হয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। ইমিগ্রেশনের লোকজন জয়নালকে আটকে রাখল। দাড়িওয়ালা একজন ইমিগ্রেশন অফিসার (যার মুখটা জয়নালের খুবই পরিচিত, কিন্তু পরিচয়টা কিছুতেই মনে আসছে না) বারবার জয়নালের পাসপোর্টের পাতা উল্টাচ্ছেন আর জয়নালের দিকে কঠিন চোখে তাকাচ্ছেন। সব যাত্রী পার হয়ে যাচ্ছে। বিমান থেকে বারবার প্লেনে উঠার তাগিদ দেয়া হচ্ছে। অধৈর্য হয়ে জয়নাল বলল, স্যার, একটু তাড়াতাড়ি করুন। প্লেন ছেড়ে দিচ্ছে। ইমিগ্রেশন অফিসার বললেন, তাড়াতাড়ি করব কীভাবে, আপনার পাসপোর্টে তো ভিসার সিল নেই। জয়নাল বলল, এটা আপনি কী বলছেন? দেখি পাসপোর্টটা! ইমিগ্রেশন অফিসার পাসপোর্টটা জয়নালের হাতে দিলেন। জয়নাল পাতা উল্টিয়ে দেখে পাসপোর্টের সবগুলো পাতা খালি, কোথাও কোনো লেখা নেই। শুধু শেষ পাতায় canceled সিল মারা।