না।
আমার মতো ঝিম ধরে ঘরে বসে থাকবি?
হু।
আচ্ছা পৃথু শোন, তোর বাবা আর মা এই দুজনের মধ্যে তুই কাকে বেশি ভালোবাসিস?
তোমাকে।
আমাকে ভালোবাসিস কেন?
জানি না। তুমি আমেরিকা চলে গেলে আমার কী রকম দুঃখ হবে জানো মামা?
কী রকম দুঃখ হবে?
টিভি না থাকলে যে-রকম দুঃখ হয় সে-রকম।
শামসুদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, তুই তো দেখি ভালোই কথা বলা শিখে গেছিস। ফুটুর ফুটুৱ করে বড় হচ্ছিস তো এই জন্য বোঝা যায় না।
পৃথু বলল, মামা তুমি আমেরিকায় কেন যাচ্ছি? বেড়াতে?
শামসুদ্দিন থমকে গেলেন। তিনি আমেরিকায় বেড়াতে যাচ্ছেন না। একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। সেই কথাটা কি পৃথুকে বলা যায়? হয়তো বলা যায়। শিশুদের সঙ্গে সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায়। ভূতপ্রেতের গল্প তারা যে আগ্রহ নিয়ে শোনে, সিরিয়াস বিষয়ে আলোচনাও তারা সে-রকম আগ্রহ নিয়েই শোনে। সিরিয়াস বিষয় সম্পর্কে মতামতও দেয়। সেই মতামত অগ্রাহ্য করার মতো না।
একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।
ও আচ্ছা!
শামসুদ্দিন বললেন, একজন মানুষ অনেক বছর আগে আমার মনে খুব কষ্ট দিয়েছিল। কেন সে কষ্ট দিয়েছিল এটা তাকে জিজ্ঞেস করব।
এখনো মনে কষ্ট আছে? আছে।
ও আচ্ছা!
পৃথু টিভি দেখা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তার পছন্দের কার্টুন শো শুরু হয়েছে। ফ্লিনস্টোন পরিবার এসে গেছে। শামসুদ্দিনও আগ্রহ নিয়েই কার্টুন দেখছেন। পৃথুর সঙ্গে পৃথুর পছন্দের অনুষ্ঠানগুলো তিনি সব সময় দেখেন। পৃথু তখন একই সঙ্গে কার্টুন দেখে এবং তার মামাকে দেখে হাসির জায়গাগুলোতে তার মামা যদি না আসে তখন সে আমার পেটে খোঁচা দেয়। শামসুদ্দিন হাসতে শুরু করলে সে গলা মিলিয়ে হাসে।
টিভিতে ফ্লিনস্টোন পরিবার পানিতে পড়ে গেছে। পরিবারের কর্তা সাঁতার কীভাবে দিতে হয় ভুলে গেছেন। তাকে তাৎক্ষণিকভাবে সাঁতার শেখানো হচ্ছে। খুবই হাস্যকর পরিস্থিতি। শামসুদ্দিন হাসছেন না। পৃথুর খোঁচা খেয়ে হাসতে শুরু করলেন। পৃথুও হাসছে। হাসতে হাসতে পৃথুর চোখে পানি এসে গেল। সে চোখের পানি মুছে বলল, যে তোমার মনে কষ্ট দিয়েছিল তার নাম কী?
শামসুদ্দিন হকচকিয়ে গেলেন। পৃথু কার্টুন ঠিকই দেখছে কিন্তু মাথায় মামার কষ্ট পাওয়ার ব্যাপারটা আছে। তিনি ইতস্তত করে বললেন, তার নাম বীথি।
পৃথু বলল, ও আচ্ছা! কার্টুনে আরো মজার দৃশ্য শুরু হয়েছে। ফ্লিনস্টোন অতি বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে সাঁতার শিখে ফেলেছে। সমস্যা একটাই–সাঁতারের টেকনিকে গণ্ডগোল হচ্ছে। সে সাঁতরে সামনে যেতে চায় কিন্তু চলে যায় পেছনে। এ দিকে পেছন থেকে ভয়ঙ্কর হাঙ্গর মাছ দেখা যাচ্ছে। ফ্লিনস্টোন সাঁতারে হাঙর থেকে যতই দূরে যেতে চায় ততই কাছে চলে আসে। পৃথু তার মামার পেটে শক্ত খোঁচা দিল–শামসুদ্দিন হাসতে শুরু করলেন।
ডালপুরি নাশতা শামসুদ্দিন খেতে পারলেন না। তেল পোড়ার গন্ধে তার বমি আসতে লাগল। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। শরীরে ক্লান্তিময় আলস্য। তিনি চাদর গায়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকলেন। তিনি বুঝতে পারছেন–জ্বর আসতে শুরু করেছে। সৈন্য-সামন্ত নিয়ে প্রবল বেগেই আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মাথা তোলার শক্তিও থাকবে না। জয়নালের খোঁজে তার একবার যাওয়া উচিত। ছেলেটা কি এখনো ফিরে নি? তার কি সমস্যা হয়েছে? কোনো একটা বিপদে যে সে পড়েছে তা বলাই বাহুল্য। বিপদটা কোন ধরনের? একসিডেন্ট করে হাত পা ভেঙে হাসপাতালে পড়ে নাই তো?
দুপুরে পৃথু এসে তার পাশে কিছুক্ষণ বসে রইল। কপালে হাত দিয়ে বলল, মামা তোমার জ্বর কি খুব বেশি নাকি? শামসুদ্দিন বললেন, হুঁ।
মাথাব্যথা করছে?
হুঁ।
শুয়ে শুয়ে টিভি দেখবে মামা? শুয়ে শুয়ে টিভি দেখলে মাথাব্যথা কমে যায়।
না, টিভি দেখব না। তুই যা, টিভি দেখতে থাক। আমার পাশে বসে থাকতে হবে না।
পৃথু ক্ষীণ গলায় বলল, মামা, দুপুরে আমরা ভাত খাব না?
আমি খাব না। তুই খাবি।
ভাত কে রাঁধবে? বাবা চলে গেছে।
দুপুরে ভাত খাবার আগে তোর বাবা ফিরে এসে ভাত রাঁধবে কিংবা হোটেল থেকে ভাত আনবে।
মা আর কোনোদিন বাসায় আসবে না?
আসবে না কেন, অবশই আসবে। রাগ কমলেই আসবে। তবে রাগটা দেরিতে পড়াই ভালো। তুই বেশিক্ষণ টিভি দেখতে পাবি।
হুঁ। মামা, আমি কি তোমার চুল টেনে দেব?
কোনো দরকার নেই। তুই যা, টিভি দেখতে থাক।
পানি খাবে? পানি এনে দিই। পানি আনতে হবে না।
পৃথু চলে গেছে। শামসুদ্দিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। জ্বরের ঘোরে তার হাত-পা কাঁপছে। টিভির শব্দ খুব কানে লাগছে। পৃথুকে বললেই সে শব্দ বন্ধ করে শুধু ছবি দেখবে। কোনো আপত্তি করবে না, মন খারাপও করবে না। কিন্তু তাকে বলতে ইচ্ছা করছে না। আহ, বাচ্চা মানুষ আগ্রহ করে দেখছে, দেখুক। শীতে শরীর কাঁপছে। একটা কম্বল গায়ে দিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো। ওয়ারড্রোবে কম্বল আছে। তিনি যে নেমে কম্বল আনবেন সেই শক্তিও নেই। মৃত্যু এসে উপস্থিত হয় নি তো? শামসুদ্দিন গভীর ঘোরে তলিয়ে গেলেন।
তার ঘুম ভাঙল পানির শব্দে। কেউ পানির কল ছেড়ে দিয়েছে। প্রবল বেগে পানির কল থেকে পানি বের হচ্ছে। পানি পড়ছে তার মাথাতেই। পানি ঢালছে রাহেলা। সে ঝুঁকে এসে বলল, ভাইজান, এখন কি একটু ভালো লাগছে?
তিনি বললেন, হুঁ।
রাহেলা বলল, তোমার জ্বর কত উঠেছিল জানো? একশ পাঁচ। গায়ের উপর ধান ছেড়ে দিলে ফুটে খই হয়ে যেত।