নায়াগ্রা জলপ্রপাতটা দেখার ইচ্ছা ছিল।
কোনো ব্যাপারই না। নিউইয়র্ক থেকে এমট্রেক নিয়ে চলে যাব। তিন থেকে সাড়ে তিনঘণ্টা লাগবে। ভাড়াও সস্তা। এক কাজে দুই কাজ হবে আমেরিকান ট্রেনও দেখা যাবে। এমট্রেক হলো বিশ্বের এক নম্বর ট্রেন সার্ভিস। আরাম আয়াশের রাজকীয় ব্যবস্থা। ট্রেনে কাচের একটা ঘর আছে। এই ঘরে হাতে বিয়ারের ক্যান নিয়ে বসবেন। চারপাশের সিন সিনারি দেখতে দেখতে যাবেন।
বিয়ারের ক্যান হাতে বসব?
কোনো অসুবিধা নেই। সেই দেশে বিয়ার পানির মতো খায়। দামও পানির মতো সস্তা। এক বোতল পানি কিনতে এক ডলার লাগে। এক ক্যান বিয়ার কিনতে লাগে পঞ্চাশ সেন্ট। চাচাজি, বিয়ার কখনো খেয়েছেন।
না।
আমিও কখনো খাই নাই। ঠিক আছে দুজনে মিলে একদিন টেস্ট করব। কী বলেন? পরে না হয় তওবা করে ফেলব। কী বলেন?
ঠিক আছে।
ষাট ডলারে গ্রে হাউন্ডের টিকিট কাটলে পুরা আমেরিকা দেখে ফেলতে পারতাম।
গ্রে হাউন্ড ব্যাপারটা কী?
গ্রে হাউন্ড হলো কুকুরের নাম। আমাদের দেশের সরাইলের কুকুরের মতো কুকুর। এই কুকুরের নামে আমেরিকানদের ইন্টারস্টেট বাস সার্ভিস আছে। আমাদের দেশের বাস আর ঐ দেশের বাসের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। বাসে চড়লে মনে হবে প্লেনের ফার্স্টক্লাসে বসে আছেন। চাচাজি আসেন, রান্না শেষ। খেয়ে নেই।
আমেরিকার খাওয়া-দাওয়া বিষয়ে তো তুমি কিছু বললে না?
খাওয়া-দাওয়া নিয়ে আপনি মোটেই চিন্তা করবেন না। ম্যাকডোনাল্ড আছে। ফাস্ট ফুড। দামে সস্তা। অতি সুস্বাদু। পুরো আমেরিকা এর উপর বেঁচে আছে। তারপর ধরেন পিজা। পিজা হাটের পিজা একবার খেলে মুখে আর অন্য কিছু রুচবে না। তারপর আছে ক্যান্টাকি ফ্রায়েড চিকেন, কর্নেল সাহেবের রেসিপি। আমেরিকার প্রধান খাদ্য সম্পর্কে তো কিছু বললামই না।
প্রধান খাদ্য কী?
প্রধান খাদ্য হলো–স্টেক। একটা স্টেক খেলে মনে হবে বেহেশতি খানা খাচ্ছেন।
ভাত তো খেতে হবে। ভাত ছাড়া অন্য যে-কোনো খাবার আমার কাছে নাশতার মতো লাগে।
নিজেকে বদলাতে হবে চাচাজি। যখন যে দেশে যাবেন তখন সেই দেশের খানা খাবেন। তারপরেও যদি খুব অসুবিধা হয়–আমি তো আছিই। চারটা চাল ফুটিয়ে দেব।
চাল পাওয়া যায়?
আরে কী বলেন, চাল পাওয়া যাবে না কেন? মোড়ে মোড়ে ইন্ডিয়ান আর বাংলাদেশী গ্রসারি স। চেপা শুটকি পর্যন্ত পাওয়া যায়।
চেপা শুঁটকি আমার খুবই পছন্দের খাবার।
চাচাজি আমেরিকায় কি আপনি চেপা শুটকি খাবার জন্যে যাচ্ছেন? আপনাকে আমেরিকায় নিয়ে দেখি সিরিয়াস বিপদে পড়ব। আপনার সঙ্গে পরিচয় না হলেই ভালো ছিল।
দুপুরে শামসুদ্দিন খুব আরাম করে খেলেন। সারাদিন হাঁটাহাঁটি করায় পেটে ক্ষুধা ছিল- জয়নালের রান্নাও অসাধারণ। কুচকুচে কালো রঙের ডিমের ভর্তার এত স্বাদ তিনি জানতেন না। ভাল-কিমাও অপূর্ব লাগল। তার মনে হলো তিনি সন্ধ্যা পর্যন্ত কালো রঙের ডাল-কিমা দিয়ে ভাত খেতে পারবেন।
খাওয়ার পর কাঁচা সুপারি দেয়া পান। জয়নাল বলল, আমেরিকায় পান পাওয়া যায় না। পান যা খাবার দেশেই খেয়ে নেন। শুকনা সুপারি দিয়ে খাবেন না। কাঁচা সুপারি–হার্টের জন্যে ভালো।
শামসদ্দিন পান খান না। আজ আগ্রহ নিয়ে পাশ চিবাতে লাগলেন। জয়নাল বলল, লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ুন তো চাচাজি। দুপুরে খাবার পর আধ ঘণ্টার ঘুমকে বলে সিয়াস্তা। স্বাস্থ্যের জন্যে অত্যন্ত ভালো। শরীর ফ্রেস হয়ে যায়। আমি আধ ঘণ্টার জন্যে ঘুরে আসি।
কেথায় যাবে।
গুরুত্বপূর্ণ একটা মিশন। দোয়া রাখবেন যেন সাকসেস পাই। কী মিশন ফিরে এসে আপনাকে বলব। আপনি আরামের ঘুম দেন। মশারি খাঁটিয়ে দেব?
দিনের বেলা মশারি খাটাবে কেন?
বাংলাদেশে চাচাজি দিনের বেলা মশারি খাটানোই জরুরি। রাতে মশা কামড়ালে কিছু যায় আসে না। দিনের মশার কামড় মানে ডেঙ্গু। এখন খোদা
না চায় যদি ডেঙ্গু হয় আমাদের আমেরিকা যাবার টাইমিং-এ গণ্ডগোল হয়ে যাবে। আমাদেরকে প্রতিটি স্টেপ নিতে হবে সাবধানে। বাস্তার পাশের ফুচকা চটপটি খাওয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ। বাসি কোনো খাবার দেখলে দশ হাত দূরে থাকবেন। ছোঁয়াচে রোগ হয়েছে এমন কোনো রোগী দেখতে যাবেন না।
কঠিন সব নিয়ম কানুন।
অবশ্যই কঠিন নিয়ম। হজে যাবার আগে হাজিদের কী করে দেখেন না? হাজি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। আলাদা করে রাখে। আমেরিকা যাত্রীদেরও এরকম আলাদা করে রাখা দরকার। সিগারেট খাবেন চাচাজি?
খেতে পারি একটা সিগারেট।
জয়নাল সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আপনার সামনে সিগারেট টানছি, আমার বেয়াদবি নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন।
দিলাম ক্ষমা করে। জয়নাল, তোমার দেশের বাড়ি কোথায়?
ময়মনসিংহ।
ময়মনসিংহ তো বিরাট এলাকা। ময়মনসিংহের কোথায়?
ময়মনসিংহের চোখের কোনায়। নেত্রকোনায়।
দেশের বাড়িতে কে আছে?
কেউ নাই। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে এক বোন আছে। খুলনায়। তার ঠিকানাও জানি না।
বোনের ঠিকানা জানো না কেন?
দশ বছর আগে রাগ করে বোনের বাসা থেকে চলে এসেছিলাম, তারপর আর যোগাযোগ করি নাই। বেনি-জামাই এর রিস্টওয়াচ পাওয়া যাচ্ছিল না। সে মনে করল আমি চুরি করে বাজারে বেঁচে দিয়েছি। কথা নাই বার্তা নাই আমার চুল ধরে থাপ্পর।
বলো কী।
মারধর সে আগেও করেছে তাতে মন খারাপ হয় নি। মনে কষ্ট পেয়েছিলাম বোনের কারণে। আমার বোন আমাকে আড়ালে নিয়ে হাতে একশ টাকা দিয়ে বলেছিল–ঘড়িটা ফিরত দিয়ে দে জয়নাল। তোর দুলাভাই-র শখের ঘড়ি। বুঝলেন চাচাজি, মনটা আমার এতই খারাপ হলো সেই একশ টাকা নিয়ে বোনের বাড়ি থেকে চলে এলাম আর ফেরত যাই নাই।