আমি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললাম, “না, না, মন খারাপ লাগছে না।”
“তাহলে প্যাঁচার মতো মুখ বন্ধ করে বসে আছিস কেন?”
প্যাঁচা আসলেই মুখ বন্ধ করে থাকে কী না সেটা নিয়ে কথা বলা যায় কিন্তু আমি লজ্জার মাথা খেয়ে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললাম, “আসলে একটু বাথরুম পেয়েছে তো”
“বাথরুম পেয়েছে?” মামা যথেষ্ট অবাক হলো কিন্তু সেটা প্রকাশ করল না। জিজ্ঞেস করল, “ছোটটা না বড়টা?”
“এখন ছোটটা হলেই হবে।”
“ইমার্জেন্সি? গাড়ি থামাব? ঐ গাছের পিছনে করে আসবি?”
আমার যে অবস্থা যে গাছের পিছনে নয় সামনেই করে ফেলতে পারি কিন্তু মামা তখন নিজেই বলল “দাঁড়া, সামনে একটা পেট্রল পাম্প দেখা যাচ্ছে। আমার তেলও নিতে হবে। এক ঢিলে দুই পাখি।”
আমি চিঁ চিঁ করে বললাম, “তিন পাখিও হতে পারে।”
মামা অবাক হয়ে বলল, “তিন পাখি?”
“হ্যাঁ। কেন জানি খুব খিদে পেয়ে গেছে।
মামা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকায়, কিছু বলল না।
মামা পেট্রল পাম্পে তার মাইক্রোবাস থামাল এবং তারপর যথেষ্ট হই চই করে তিনটা পাখি মারা হলো। মামা পেট্রোল নিল, আমি হিস্যু করলাম। তারপর আমি পেট্রোল পাম্পের পাশে ছোট রেস্টুরেন্ট থেকে ডিম পরটা খেলাম। আমার পেটের মাঝে কোথায় এতো জায়গা ছিল কে জানত?
এইবারে যখন আবার রওনা দিয়েছি তখন আমি যথেষ্ট চাঙ্গা। পেট ভরা এবং তলপেট খালি, কাজেই মন মেজাজ ভালো হতেই পারে। আমি রাস্তার দুই পাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে মামার সাথে গল্প করতে থাকি।
মামা তার বেসুরো গান গাইতে গাইতে হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, “তোকে একটা জিনিস সাবধান করে দিই।”
“কী জিনিস মামা?”
“এই দেশের মানুষের কৌতূহল খুব বেশি। দেখবি সবাই একশ রকম জিনিস জিজ্ঞেস করবে। বাড়ি কই, কী করি, কতো টাকা কামাই করি, বিয়ে করেছি কি না- এরকম হ্যাঁনো ত্যানো হাবি জাবি একশ জিনিস। উত্তর দিতে কোনো সমস্যা নাই– শুধু একটা জিনিস বলা যাবে না।”
‘কী বলা যাবে না?”
“আমি আসলে কী করছি। ইউরেনিয়াম খুঁজছি এটা বলা যাবে না।”
“কেন মামা?”
“কারণ এটা সিক্রেট। ইউরেনিয়াম অসম্ভব স্ট্র্যাটেজিক এলিমেন্ট। সারা পৃথিবীর নজর ইউরেনিয়ামের জন্য। আসলেই যদি পেয়ে যাই আর জানাজানি হয়ে যায় সর্বনাশ হয়ে যাবে!”
এরকম একটা ভয়ংকর প্রজেক্টের আমি অংশ হয়ে গেছি চিন্তা করেই আমি উত্তেজিত হয়ে উঠি। নিজেকে হলিউডের সিনেমার নায়ক নায়ক মনে হতে থাকে। আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, “তুমি কোনো চিন্তা করো না মামা, আমি মরে গেলেও কাউকে কিছু বলব না।”
“তাহলে কী বলবি সেটা ঠিক করে রাখ।”
“কিছুই বলব না। চুপ করে থাকব। বলব সিক্রেট প্রজেক্ট।”
মামা মাথা নাড়লেন, বলল, “উঁহু। কিছু একটা বলতে হবে।”
আমি মাথা চুলকে বললাম, “বলব, গুপ্তধন খুঁজছি। একজন জলদস্যু মাটির নিচে সোনাদানা পুতে রেখেছিল সেটা খুঁজছি।”
মামা হাসল, বলল, “ইন্টারেস্টিং! কিন্তু তখন আরো একশ প্রশ্ন করবে। জলদস্যু পানিতে না রেখে শুকনার মাঝে কেন সোনাদানা পুতে রেখেছে? জলদস্যুর নাম কী? বাড়ি কোথায়? বউ কয়টা? ছেলেপিলে আছে? এই দেশের মানুষের কৌতূহলের কোনো মা বাপ নাই।”
আমি আবার মাথা চুলকালাম, তারপর বললাম, “তাহলে বলতে পারি ডাইনোসরের হাড্ডি গুড্ডি খুঁজছি।”
“হাড্ডি গুড্ডি? মানে ফসিল?”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “হ্যাঁ ফসিল। বলব ডাইনোসরের ফসিল খুঁজছি।”
মামা মুখ সূচালো করে কিছু একটা চিন্তা করল, তারপর বলল, “উঁহু। এটা পলি মাটির দেশ, ডাইনোসরের ফসিল পাওয়ার কথা না। জানাজানি হলে পত্রিকায় আর্টিকেল উঠে যাবে। লিখবে, বিজ্ঞানের নামে অর্থের অপচয়। দুর্নীতিবাজ বিজ্ঞানীর প্রতারণা। বেইজ্জতি ব্যাপার হবে।”
আমি আবার মাথা চুলকালাম। কোনো একটা কিছু চিন্তা করতে কেন মাথা চুলকায় কে জানে। এটা নিয়েও নিশ্চয়ই গবেষণা হয়েছে। মাথা চুলকাতে চুলকাতে শেষ পর্যন্ত একটা আইডিয়া বের হলো। বললাম, “বলতে পারি যে পরিবেশ দূষণ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। মাটি তুলে তুলে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে এর ভিতরে আলতু ফালতু কেমিক্যাল আছে না নাই।”
মামা মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। এইটা বলা যায়। আজকাল পরিবেশ দূষণ খুব হট যাচ্ছে। গুড আইডিয়া।”
আমি একটা গুড আইডিয়া দিতে পেরেছি সেইজন্য আমার রীতিমতো অহংকার হতে লাগল। অহংকারের জন্যই কি না কে জানে, নাকি চিন্তা করার জন্য আমার একটু পরে আবার খিদে পেয়ে গেল। মামার নিজেরও একটু চা খাওয়ার ইচ্ছা করতে লাগল। তাই আমরা আবার থামলাম। মামা চা খেলো আর আমি আস্ত একটা হ্যামবার্গার খেয়ে ফেললাম।
আমরা এইভাবে যেতে থাকি। প্রতি দুই ঘণ্টা পর পর মামা তার মাইক্রোবাস থামিয়ে হাত পা নাড়িয়ে শরীরের আড়মোড়া ভাঙ্গে, তারপর কড়া লিকারের চা খায়। আমি অবশ্যি চা কফি খাই না সত্যিকারের খাবার খাই। একবার একটা ক্রিমরোল খেলাম, আরেকবার দই মিষ্টি আরেকবার গরম জিলাপি, আরেকবার চিকেন প্যাটিস মামা পর্যন্ত আমার খাওয়া দেখে অবাক হয়ে গেল। আমার মনে হতে লাগল বিজ্ঞানের গবেষণায় যখন এতো আনন্দ আমি বড় হয়ে বিজ্ঞানী হয়ে যাই না কেন?
.
মামা কোথায় যাবে আগে থেকে ঠিক করে রেখেছে। হাওড়ের একপাশে নদী, অন্য পাশে একটা টিলা, মোটামুটি নির্জন জায়গা তাই দিনের আলো থাকতে থাকতে মামা পৌঁছে যেতে চাইছে। মামা ঘড়ি দেখল, তার জিপিএস দেখল তারপর সময় বাঁচানোর জন্য মাইক্রোবাসের স্পিড বাড়িয়ে দিল। একটা ছোট শহর পার হয়ে আমরা পনেরো কুঁড়ি মিনিট গিয়েছি তখন হঠাৎ করে রাস্তার পাশে ছোট একটা ভীড় দেখতে পেলাম। জায়গাটা পার হওয়ার সময় দেখলাম রাস্তার পাশে একটা গাড়ি কাত হয়ে আছে। গাড়ির সামনের অংশটা দুমড়ে মুচড়ে গেছে। মনে হলো কয়েকজন রাস্তার পাশে মাটিতে শুয়ে বসে আছে। গাড়ি একসিডেন্ট।