“এইটা কী?”
“এইটার নাম গাইগার কাউন্টার।”
মানুষটা কী বুঝল কে জানে, আবার একটা ছোট লাফ দিয়ে বলল, “সর্বনাশ! কে তোমাকে এটা দিয়েছে? ফালাও নিচে ফালাও। এক্ষুণি নিচে ফালাও।”
মানুষটার কথা শুনে আমার এই মূল্যবান গাইগার কাউন্টার নিচে ফেলা ঠিক হবে না। কিন্তু তাকে কীভাবে শান্ত করব বুঝতে পারলাম না। বললাম, “এইটা নিচে ফেলা যাবে না। এইটা অনেক মূল্যবান যন্ত্র।”
“তুমি এই মূল্যবান যন্ত্র কোনখানে পেয়েছ? এইটা দিয়ে কী করে?”
একসাথে দুইটা প্রশ্ন, কীভাবে উত্তর দেব বুঝতে পারলাম না। প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যখন কঠিন হয় তখন তার উত্তর দিতে হয় প্রশ্ন করে। কাজেই আমি সেই টেকনিক শুরু করলাম, বললাম, “আপনি সাইন্টিস কী জানেন?”
“সাইন্টিস?”
“হ্যাঁ।”
“কেন? কী হয়েছে সাইন্টিসের?”
মানুষটা এখন আমার টেকনিক শুরু করেছে। আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে প্রশ্ন দিয়ে। কী মুশকিল! কিন্তু কিছু একটা উত্তর দিতে হবে, তাই বললাম, “আমার মামা হচ্ছে সাইন্টিস, তাই মামা আমাকে এই যন্ত্রটা দিয়েছে গবেষণা করার জন্য।”
মানুষটা আমার কথা বিশ্বাস করল না, বলল, “তুমি এতো ছোট মানুষ, তুমি কেমন করে গবেষণা করবা?” তারপর নাক দিয়ে বাতাস বের করে ঘোত করে একটা শব্দ করল। অবিশ্বাসের শব্দ।
আমি বুঝতে পারলাম এই মানুষটার সাথে কথা চালিয়ে যাওয়া খুব মুশকিল, তাই খামাখা চেষ্টা করে লাভ নাই। আমার এখন এই মানুষটির কাছ থেকে চলে যাওয়াটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আমি তাই আর কিছু না বলে হাঁটা শুরু করলাম, সাথে সাথে মানুষটা চিৎকার করে বলল, “খবরদার। খামোশ। নড়বে না, তুমি নড়বে না।”
আমি বললাম, “নড়ব না?”
“না।”
“কেন?”
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মানুষটা তার পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা লাল রংয়ের মোবাইল ফোন বের করে সেটাতে দুই একটা চাপ দিয়েই কথা বলতে শুরু করল। “হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো হ্যালো আক্কাইস্যা হ্যালো হ্যালো”।
কাউকে ফোন করলে কানেকশান হতে যে সময় লাগে এই মানুষটা সেটা জানে না, ডায়াল করেই সে আক্কাস মানুষটাকে ডাকাডাকি শুরু করেছে। যাই হোক শেষ পর্যন্ত আক্কাস নামের মানুষটা ফোন ধরল তখন একুশ দাড়ির মানুষটা কথা বলতে শুরু করল, “হ্যালো আক্কাইস্যা, ফোন ধরিস না কেন? কততক্ষণ থেকে ফোন করতেছি। শোন ভালো করে কী বলি, এক্ষুণি আয়, নদীর পাড়ে জঙ্গলের কিনারায় বড় বটগাছের নিচে। একটা ছেমড়া এক অস্ত্র নিয়ে ঘুরতেছে তারে ধরে বেন্ধে নিতে হবে”
আমার চোয়াল স্কুলে পড়ল। বলে কী এই মানুষ? আমাকে ধরে বেন্ধে নিতে হবে? কোথায় ধরে বেন্ধে নিতে হবে? আমি বুঝতে পারলাম আমার আর এই মানুষের কথাবার্তা শোনার দরকার নেই। আমি হাঁটা শুরু করলাম। যদি আসলেই আমাকে ধরার চেষ্টা করে তখন দেখা যাবে কী করা যায়। যদি সত্যি সত্যি দরকার হয় তখন এই মানুষের হাত থেকে বাঁচার জন্য গাইগার কাউন্টারটাকে অস্ত্রের মতো ব্যবহার করে ভয় দেখানো যেতে পারে।
আমি পিছনের দিকে না তাকিয়ে লম্বা পা ফেলে হাঁটতে থাকি। ঠিক তখন শুনতে পেলাম পেছন থেকে কে যেন ডাকলো, “টোপন! তুমি এখানে? আমরা তোমাকে কখন থেকে খুঁজছি।”
আমি পিছন ফিরে তাকালাম, দেখলাম, মাহবুব, ডোরিন আর টনি।
আমার বুকের মাঝে পানি ফিরে এলো। একুশ দাড়ির মানুষটার সাথে আমার আর একা ঝগড়াঝাটি করতে হবে না। আমরা চারজন মিলে এখন এই খ্যাপা মানুষের সাথে তর্ক বিতর্ক করতে পারব।
অবশ্য তার আর দরকার হলো না। আমার সাথে অন্য তিনজন একত্র হওয়ার সাথে সাথেই একুশ দাড়ির মানুষটার উত্তেজনা মিইয়ে গেল। মানুষটা কেমন যেন ম্যাদা মেরে গেল। আমাকে ধরে বেন্ধে ফেলার চেষ্টা না করে মাথা নিচু করে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করে দিল।
০৭. মানুষটার আজব কাজকর্ম
০৭.
আমার কাছ থেকে সবকিছু শোনার পর প্রথমে একুশ দাড়ির মানুষটার আজব কাজকর্ম নিয়ে সবাই একটু হাসাহাসি করলাম, তারপর মাহবুব প্রথমে আমাদেরকে নিয়ে কাছাকাছি একটা বাজারে রওনা দিল। জায়গাটা বেশ দূরে কিন্তু দেখা গেল হাঁটতে কারো আপত্তি নাই। আশে পাশে মানুষ নেই তাই আমরা লাফাতে লাফাতে কিংবা গান গাইতে গাইতে যেতে পারব কেউ কিছু বলতে আসবে না। হাতের গাইগার কাউন্টারটি কী সেটা একটু ব্যাখ্যা করতে হলো। আমি বানিয়ে বানিয়ে বললাম এটা বাতাসের মাঝে কার্বন ডাই অক্সাইড কতোটুকু সেটা মাপার যন্ত্র। তবে নামটা শুনে তারা আমার সাথে একমত হলো যে গাইগার বেচারার বাবা মায়ের তার জন্য আরেকটু ভালো নাম দেওয়া উচিত ছিল। টনি অবশ্য বলার চেষ্টা করল যে গাইগার নিশ্চয়ই পারিবারিক নাম, তার বাবা মায়ের নামও নিশ্চয়ই গাইগার। আমরা সেটা শুনেও না শোনার ভান করলাম, একটা মজার বিষয়কে কেউ কাঠখোট্টা সত্যি তথ্য দিয়ে পানসে করে দিতে কেউ চায় না।
আমরা যখন হাঁটছি তখন আমি টনির দিকে তাকালাম, তার মুখটা যথেষ্ট ভোলা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি না আসতে চাইছিলে না, তাহলে আসলে কেন?”
টনি বলল, “আমি আসলেই আসতে চাই নাই। শুয়ে শুয়ে টিভি দেখব ভেবেছিলাম। কিন্তু
“কিন্তু কী?”
“হঠাৎ করে কাদের মামা চলে এসেছে।”
‘কাদের মামাটা কে?”
“আমার একজন মামা। খালি প্রশ্ন করে! খুবই যন্ত্রণা।”