ছবিদি মিত্তির বাড়ির মেয়ে। তার বাবা শিবশংকর মিত্তির ছিলেন নামকরা উকিল। রানিবুবুর সঙ্গে সঙ্গে প্রায়ই মিত্তির বাড়িতে যেতাম আমি। ছবিদির ঘরে দেয়ালের তাকে ছোট দুটো কাচের বয়ামে কুঁচ সাজানো থাকতো। একটায় লাল কুঁচ। অপরটায় লালের মাথায় ছোট্ট কালো ফোঁটা। ফাঁক পেয়ে এবার বেশকিছু কুঁচ বের করে নিয়েছিলাম। ঘরে ফিরে শিশিতে ভরে সেই কুঁচগুলো আমি তোষকের তলায় রেখে দিয়েছিলাম।
ছবিদিদের বাড়ি থেকে আমি আরো একটি বস্তু সংগ্রহ করেছিলাম, সেটি একটি রাক্ষসের ছবি। মোটা একটি বইয়ের ভেতর থেকে রঙিন পাতাটি খাসিয়ে নিয়ে বইটি যথাস্থানে আবার রেখে দিয়েছিলাম। ফেদুর ঝোলার ভেতরের কালো কুচকুচে শিং-এর সঙ্গে ছবির রাক্ষসের শিং-এর বেশ মিল ছিল।
কুঁচের কথা যেভাবেই হোক ছবিদি জেনে গিয়েছিল। একদিন বললে পোকা, তোকে আমি ভালো জানতাম—
কিছু না বুঝে আমি তার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।
ছবিদি বললে, আমি কি দিতাম না, চাইলেই তো পারতিস, মনিদার পাল্লায় পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিস তুইও—
কুঁচভরা ছোট্ট একটা বয়াম দিয়ে দিয়েছিল ছবিদি, মনে আছে।
একদিন সকলে মিলে আমাদের বাগানে চড়ুইভাতি করলে। সেদিন সকলে শখ করে শাড়ি পরেছিল। মনি ভাইজান চোখ মটকে ছবিদিকে বললে, স্টাইল!–-
সে কি কান্না ছবিদির, ছোটলোক। ছোটলোক! রানিবুবু ছুটে গিয়ে তখুক তখনই মাকে বলে দিয়েছিল।
রাখ, তোর বজ্জাতিপনা আমি বার করছি–এই বলে হাতে কাঠের বেলুন নিয়ে মা সেই কোহিতুর আমগাছের গোড়া অবধি মনি ভাইজানকে তাড়া করেছিল।
সেসব কতো কথা। ইচ্ছে করলেও এখন আর সব মনে পড়ে না। কতো কথা, কতো চার ভঁজ-করা ছবি, তেশিরা কাচ, লালকুঁচ, কতো সকাল-দুপুর-বিকেল বোকার মতো হারিয়ে ফেলেছে পোকা! কখনো মনে হয় নি, একদিন সবকিছুরই আবার খোঁজ পড়বে নতুন করে। বড় অবহেলা ছিল পোকার, বড় অবহেলা। অযত্ন আর হেলাফেলায় কতো কিছুই যে সে হারিয়ে ফেলেছে! জিনজার এখন গানের মতো বাজে, হিনজার এখন বুকের ভেতরে নিরবচ্ছিন্ন শব্দ তোলে। হু হু বাতাসের গায়ে নকশা-ভোলা ফুলের মতো অবিরল আকুলতা, পোকার বুকের ভেতরের ফাঁকা দালানকোঠা গুম গুম করে বাজে, পোকা তুই মর, পোকা তুই মর।
যা কিছু নিঃশব্দ, যা কিছু শব্দময়, যা কিছু দৃশ্যগোচর, দৃশ্যাতীত, সবকিছুই একজোট হয়ে হাত ধরাধরি করে ঘিরে ধরে; অদ্ভুত এক বাজনার তালে তালে আস্ত একটি রাত মোমের মতো গলে পড়ে, জিনজার-হিনজার জিনজার-গিনজার, জিনজার-হিনজার পোকা শোনে, শুনতে পায়। পোকা পোকা হয়ে যায়।
০৪. গিরিবালা, ও গিরিবালা
গিরিবালা, ও গিরিবালা–ঘুমন্ত রেখার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে আবদুল খালেক ডাকে, তোমার এতো রাগ কেন গিরিবালা?
একটা হাত ঠেলে দেয় রেখা। বোঝা গেল, সে এততক্ষণ ঘুমায়নি; চোখ বন্ধ করে পড়ে ছিল।
।আমাকে শুতে দেবে না বুঝি–
রেখা একপাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দেয়। বললে, না এলেই হতো! হারিকেনের সবটুকু তেল শেষ করে তবে শান্তি হয়েছে তোমার–
আবদুল খালেক শুয়ে বললে, তুমি শুধু রাগ করো, আগের মতো আর আমাকে ভালোবাসে না
ইস্ মাঝরাতে ওনার একেবারে উপচে উঠছে। কি লাভ ওইসব ছাইভস্ম করে, তোমার এক একটা পাগলামি দেখলে গা রি রি করে জ্বলে আমার!
কি করবো, করতে হচ্ছে—
করতে হচ্ছে মানে?
আরে মালেক, মালেক, ওই হারামজাদাই তো আমাকে ফাঁসিয়েছে। ডায়েরি করে পাগল করে তুলেছে কিছুকাল যাবৎ। লেখক মানুষ, বুঝলে না, সবকিছুই ও কাজে লাগায়—
রেখা বিরক্ত হয়ে বললে, এতে তোমার কি লাভ?
বন্ধুর কাজে লাগলাম, নিজেরও কিছুটা সময় কাটলো—
রেখা বললে, সময় কাটানোটা তোমার জন্যে এখন একটা মস্ত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, বুঝতে পারছি–
আবদুল খালেক বললে, কেন যে তুমি সবকিছু বুঝতে যাও—
রেখা বললে, আমি খুব খারাপ!
তা বলি নি–আবদুল খালেক রেখাকে জড়িয়ে ধরে বললে, তোমার কাজ শুধু আমাকে ভালোবাসা, জীবনভর ভালোবেসে বেসে একদম পচিয়ে দেয়া–
দিন দিন তুমি ছোকরা হচ্ছো!
ছোকরা তো আছিই, একটা মাত্র ছেলে, নবছরের বিবাহিত জীবন, টুকটুকে বৌ, বুড়োটা হলাম কিভাবে?
রেখা পাশ ফিরে শুয়ে বললে, দয়া করে এখন আমাকে ঘুমোতে দাও। তোমার ইচ্ছে না হয় বসে বসে যা ইচ্ছে তাই করো গে—
আবদুল খালেক বললে, তোমার ভাবগতিক ভালো ঠেকছে না হে। হপ্তাটা মাঠে মারা যাবে নাকি?
চুপ করে শুয়ে থাকো—
ধমকাচ্ছো কেন এমন?
বলছি তো আমারূ র্শীর ভালো নেই—
শরীর, না মন?
কোন্ খবরটা রাখো তুমি! পরশু দুপুর থেকে যা খারাপ যাচ্ছে শরীর–
মাসের মাঝখানে হঠাৎ?
কি করে বলবো! কিভাবে যে কেটেছে সারাটা দিন!
আমাকে বললানি তো?
কি লাভ তোমাকে বলে? কোনো ব্যবস্থা করতে? কবে আমার ব্যাপার নিয়ে তুমি মাথা ঘামিয়েছিলে?
তবু বলা উচিত ছিল তোমার—
কেন আগেও তো এমন হয়েছে, নতুন কিছু তো আর নয়, আমার ব্যাপার নিয়ে খামোখা তোমার মাথা ঘামানোর দরকার নেই—
কিছু একটা ভাবল আবদুল খালেক। একটা সিগ্রেট ধরালো। বললে, আমি কি বলি জানো, তোমার ঐ ট্যাবলেট-ফ্যাবলেট এবার বাদ দাও। আর কতো, অনেক তো হলো—
তোমার কি, তুমি তো বলেই খালাস। তারপর কিছু একটা হয়ে গেলে?
হোক না, মন্দ কি! ছেলেপিলেয় ঘর ভরে যাক। বাগান হয়ে যাক। আমরা তো সব মিলে সাত ভাইবোন ছিলাম, মরে হেজে শেষ পর্যন্ত ঠেকেছিল চারে—
ঝক্কি সামলাতে পারবে? খাওয়াতে পারবে?