চোখে পড়লে এইসব ব্যাপার নিয়ে টিপু ভাইজান অভিযোগ তুলতো, আব্বাকে দেখতাম বকাঝকা করতে।
এমন ঘটলে মনি ভাইজান রেগে গিয়ে টিপু ভাইজানকে বলতো, দাঁড়া, তোর লাগালাগি আমি বার করছি। সব্বাইকে বলে দেবো তোর নাম দুদু।
টিপু ভাইজানের ডাক নাম ছিল দুদু। আমাদের নানীমার দেওয়া নাম। এই নাম ধরে অনেকেই তাকে ক্ষ্যাপাতো বলে শেষ পর্যন্ত সেটা বাতিল হয়ে যায়। এই নামটার ব্যাপারে টিপু ভাইজানের ভেতরে ভেতরে বোধহয় একটা ভয় ছিল।
বাধ্য হয়ে মনি ভাইজানের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করে নিতে হতো। বোঝাপড়া মানে, কিছু না কিছু একটা ঘুস দিয়ে তবে রফা।
প্রতি বছরই রথের মেলা থেকে কিছু না কিছু চারা অথবা কলম কেনা হতো। আব্বা আমাদের সকলের ভেতরে সেগুলো ভাগ করে দিত। ভারি সুন্দর ধরেছিল হাতের একটা ফলশা গাছ। পুঁটির কাছ থেকে শিখে আমিও ঐ গাছটার সঙ্গে কথা বলতাম। গাছটা উত্তর দিত না ঠিকই, কিন্তু জন্তুর কানের মতো চওড়া চওড়া পাতা নেড়ে খুব মনোযাগ দিয়ে সব শুনতো।
টিপু ভাইজানের লাগানো গোলাপজাম গাছের মাথায় একদিন সকালে দেখা গেল একটা খোলাপিঠে ঝুলছে। হুলস্থুল কাণ্ড। কিন্তু পিঠেটি আমাদের কারে ভাগ্যে জোটেনি। একটা হনুমান দেখতে পেয়ে লাফ দিয়ে এসে সেটাকে ছিঁড়ে নিয়ে গালে পপারে। এই নিয়ে মনি ভাইজানের একটা গান ছিল, বীর হনুমান লাফ দিয়েছে, বাঁচবে না বাঁচবে না–
কিছুদিন যেতে না যেতেই দেখা গেল, গোটা তিনেকপিঠে ধরেছে গাছে। টিপু ভাইজানকে তখন মনি ভাইজান বললে, তোকে ভুল করে গোলাপজাম গাছের চারা মনে করে খোলাপিঠের চারাই দিয়ে দিয়েছে—
টিপু ভাইজান বলেছিল, হতেও পারে, অসম্ভব কিছু নয়!
এই নিয়ে অনেক হাসাহাসি হয়েছিল। গল্পটা রটে গিয়েছিল মধ্যমগ্রাম কি কাজীপাড়া পর্যন্ত। টিপুর ভাইজানকে দেখলে দুর্গাদাস বাবু ঠাট্টা করে বলতো, ও টিপু পিঠে বেচবে, কতো করে নেবে জোড়া?
কেউবা জিগ্যেস করতো, তোমার পিঠেগাছের ডালের তক্তা কেমন, মজবুত তো? আমার একটা জলচৌকি দরকার—
টিপু ভাইজান এইসব ব্যাপারে খুব বেশি একটা মেলামেশা করতো না কারো সঙ্গে। তার স্বভাবও ছিল কিছুটা মখুচোরাগোছের। ইস্কুল আর বাড়ি, বাড়ি আর ইস্কুল, এই ছিল তার সীমানা।
দুপুরে মা যখন কাঁথা সেলাই করতে বসতো, তখন রানিবুবু তাকে সাহায্য করতো। মা যখন নতুন কথা পাড়তো, তখন আমিও ধারেকাছে থাকতাম। ওটা বোধহয় একটা নেশা ছিল মার। সুঁয়ে সুতো পরিয়ে দেওয়া, ঝোল চেকে নুন হয়েছে কি না বলা, একটা কঞ্চি হাতে করে বসে বসে রোদে দেয়া আচার পাহারা দেওয়া আমার কাজ তো ছিল এইসবই।
পাড় জুড়ে জুড়ে বড় সুন্দর একটা দস্তরখানা তৈরি করেছিল মা। মনি ভাইজান বলতো, ওটা রেখে দাও, আমার বউ আসলে দিও–
মাঝে মাঝে দূর সম্পর্কের এক নানা আসতেন আমাদের বাড়িতে। সবাই বলতো তাঁর মাথায় না-কি ছিট। স্বদেশী আন্দোলনের সময় তিনি ইংরেজের চাকরি ছেড়ে বইয়ের ব্যবসা খুলেছিলেন। তবে সে ব্যবসা তাঁর চলেনি। পরে ইস্কুলে মাস্টারি করতেন।
আমরা যখন তাকে দেখি, তখন তাঁর ঝরঝরে অবস্থা। তাঁর কোটের পকেটে পিপড়ে আর তেলাপোকার বাস ছিল। পকেটে চিনি রাখতেন, মাঝে মাঝে কাঁকড়াবিছেও রাখতেন তিনি পকেটে! পিপড়েগুলো ছিল তাঁর পোষা। কখনো শুনিনি তাঁকে কামড়েছে।
কামড়ায় না?
কেন কামড়াবে? আমি তো ওদের কামড়াইনি! বলতেন, আল্লাতালার জীব, সব এক–
বলতেন, ম-এ মুসলমান, ম-এ মু্র্দফরাস, ম-এ মুচি, সব সমান।
তাঁর কোলে যখন আমাদের রানিবুকুর বিড়াল কুন্তি লাফ মেরে উঠে বসতে, তিনি বলতেন, বড় আদর চায় এরা, এরা আদর ভালোবাসে, সবাই আদর ভালোবাসে—
সিনেমার সন্ধ্যারানী বলতে অজ্ঞান ছিলেন। বলতেন, আমি ওকে বিয়ে করবো, বড় ভালো মেয়ে, বড় ভালো মেয়ে, আহা কি মায়া–
মনি ভাইজান বলতো, নানাভাই, আজ তোমার সেই সন্ধ্যারানী আসবে!
নানা বলতেন, সত্যি?
বিকেলে দেখো, আমি তোমার কথা বলেছি—
বিকেলে একহাত ঘোমটা টেনে দরজার সামনে যে এসে দাঁড়ালো, নানাভাই প্রথমে তাকে চিনতে পারেন নি। কেমন একটু হতভম্ব মতো হয়ে গিয়েছিলেন প্রথমটায়। অবশ্য পরে ধরতে পেরেছিলেন। ওল্টানো ছাতা ধরে তাড়া করেছিলেন তিনি শাড়ি জড়ানো মনি ভাইজানকে, সেই বড় রাস্তা পর্যন্ত। কতো কি যে হতো! রানিবুবুর ক্লাসের অনেক মেয়েরাই আসতো আমাদের বাড়িতে। ছবি, তরু, রমা, রানু, বেলা, শিবানী, আরো অনেকে। তারা সবাই ছিল চৌধুরীপাড়ার মেয়ে। দক্ষিণ পাড়ার মানুষজনের ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়টা একটু বেশিই ছিল, তারা গা বাঁচিয়ে চলতে সবসময়; তারা আমাদের বলতো মোচোনমান। গলায় গলায় ভাব ছিল ছবিদির সঙ্গে। ছবিদিকেও ক্ষেপাতো মনি ভাইজান। ব-র-ক-ধ-ঝ বললেই ছবিদি চটে যেতো। চটলে মনি ভাইজানকে বলতো, গুপ্তা।
মনি ভাইজান বলতো, গুণ্ডি।
তোর কোনো লাজলজ্জা নেই, মেয়েদের পেছনে লাগিস কেন? এই বলে বকাবকি করতো মা।
ওরা এতো গুজগুজ করে কেন?
তাতে তোর কি, তোর কি দরকার এসব দেখার?
ছবিদি আমাকে খুব ভালোবাসতো। কত জলছবিই যে আমি তার কাছ থেকে পেয়েছিলাম। একবার বইয়ের মলাটে এঁকে দিয়েছিল একটা রাজহাঁস, সে কি তার গর্বিত ভঙ্গি, আমি সেটা খুব যত্ন করে চারটে ভাঁজ ফেলে তোষকের তলায় রেখে দিয়েছিলাম।
তোষকের তলায় দেশলায়ের বাক্সের ভেতর পুরে টিকটিকির ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা তোলাও ছিল একটা খেলা।