তার ঝোলায় একটা রাক্ষসের শিং ছিল; তার ভেতরে খুচরো পয়সা ভরে মুখে ছিপি এঁটে রাখতো। একটা কৌটোয় সুগন্ধি কবিরাজি বড়ি ভরা থাকতো; কাশির দোষ থাকায় সে ঐ বড়ি গালে রাখতো। চাইলে একটার বেশি কখনোই দিত না। একবার মনি ভাইজান ফেদুর কৌটোর সব বড়ি বেমালুম সাবাড় করে দিয়েছিল।
ছোলাভাজা, মটরভাজা, কিংবা আখ চিবুতে চিবুতে গিরিবালার দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে মনি ভাইজান ডাকতো, গিরিবালা, ও গিরিবালা–
গিরিবালা গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করতো, কে র্যা?
মনি ভাইজান বলতে, আমি তোর বর, মনি—
ওরে আমর ধম্মোপুত্তুর র্যা?
মটরভাজা এনেছি খাবি?
মন খারাপ থাকলে এক একদিন হাউমাউ করে কান্নাকাটি জুড়ে দিত। অকারণেও অনেক সময় তাকে এইভাবে পা ছড়িয়ে বসে কপাল ঠুকে বিলাপ করে কাঁদতে দেখা যেতো।
মনি ভাইজান তখন বলবে, দ্যাখো দ্যাখো, কি সুন্দর বুড়ির গানের গলা!
মর আবাগীর ব্যাটা, মর! তোর ওলাউঠো হোক, জিব খসে পড়ক–গিরিবালা সুর করে এইসব জুড়লে মনি ভাইজান পকেট থেকে ভেলিগুড়ের প্যাকেট বের করে তার হাতে দিত। মনি ভাইজানের অভ্যেস ছিল চাল-তেল-চিনি সকলের অগোচরে বাড়ি থেকে সরানো। গিরিবালা খুব খুশি হলে মনি ভাইজানের গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতো, অ সোনা, অ মাণিক, রাজচক্কোত্তি হ বাপ, রাজকপালে হ বাপ, আমার মতো ফুটোকপালে যেন কেউ না হয়–
তিনকুলে কেউ ছিল না বুড়ির। একটা পলস্তারা খসা দোতলা বাড়ির কোণের ঘর আগলে কিভাবে যে পড়ে থাকতো। উঠোনময় ছিল জঙ্গল। উঠোনের পাঁচিলের গা ঘেঁষে একটা কাঁঠাল গাছ, সেখানে আস্তানা ছিল তক্ষকের। মাঝে মাঝে তক্ষকটা যখন ডেকে উঠতো, তখন গোটা উঠোন, উঠোন ঘেঁষা বাড়িটা, কেমন যেন হা হা করে উঠতো সবকিছু। উঠোনের জঙ্গলের ভেতর রাশি রাশি তারার মতো ফুটে থাকতো করমচা। সিড়ির গা ছুঁয়ে ছিল গাঁদা, দোপাটি আর সন্ধ্যামণির ঝোপ; আপনা আপনিই হতো এসব।
গিরিবালা উঠোনের জঙ্গলের দিকে আঙুল বাড়িয়ে মাঝে মাঝে মনি ভাইজানকে বলতো, রাতের বেলায় কারা যেন হোথায় আসে, ফিসফাস করে কথা কয়–
তোর ঘাড় মটকাবে একদিন, দেখিস?
বুড়ি বলতো, ওরা সব আমার আপনজন, একদিন তো এরা সব এ বাড়িতেই ছিল। বাড়ির মায়া, সে কি কেউ কখনো ত্যাগ করতে পারে র্যা! বড় মায়া! দ্যাখনা, দাঁতে দড়ি দিয়ে কেমন পড়ে রইলুম, সে তো ঐ মায়ার জন্যেই–
কলুদের মেয়েরা গিরিবালার বাড়ির সবগুলো দেয়ালে খুঁটে দিয়ে রাখতো। কার বারণ কে শোনে। একে ছানিপড়া চোখ, তায় হাড় জিরজিরে; এমন কেউ নেই যে তার হয়ে দুটো কথা বলে; ঘরের দেয়াল, বারান্দার গা, পাঁচিলের গা, কোথাও বাদ রাখতো না। মনে হতো গোটা বাড়িটাই ঘুঁটের তৈরি।
কলুদের মেয়েরা ছিল ভারি মুখফোঁড়া। চোপার জোর আর গলাবাজিতে তাদের সঙ্গে কেউ পেরে উঠতো না। খুব ছোট থাকতেই মেয়েগুলোর বিয়ে হয়ে যেত।
গিরিবালার সঙ্গে প্রায়ই এটা-ওটা নিয়ে ঝগড়া লাগতো ওদের। শেষ পর্যন্ত ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে কপালে করাঘাত শুরু করতো বুড়ি। আর শাপমণ্যি, সে তো আছেই।
আমাদের বাড়িতেই ঘুঁটের দরকার হতো। মনি ভাইজান পয়সা নিজের পকেটে রেখে গিরিবালার দেয়াল থেকে থলে ভরে খুঁটে আনতো। একবার ব্যাপারটা আমি দেখে ফেলি। মনি ভাইজান বলেছিল, বলবি না কাউকে, তোকে ভাগ দেব।
বলার সাহস আমার এমনিতেই ছিল না। তবু নানাভাবে মনি ভাইজান এটা-সেটা ভাগ দিতো। যেদিন পরোটা আর ডিম হতে সকালে, আমি আগেই ডিম খেয়ে ফেলতাম। মনি ভাইজান নিজের ভাগ থেকে আমাকে ধার দিতো। এইভাবে মাছগোশ থেকে শুরু করে সবকিছুই ধার দিতো খাবার সময়। ঝগড়া বাধলেই বলতো, এক্ষুণি সব ফেরত চাই!
অবশ্য আমাকে কখনো শোধ দিতে হয়নি সেসব।
মনি ভাইজান বাক্সের তালা খোলার মন্ত্র জানতো। টিনের ফলা লাগানো তীর ছুঁড়ে গাছ থেকে এঁচোড় পাড়তে পারতো। পুকুরে নেমে পাল্লা দিয়ে টিপু ভাইজানের সঙ্গে সাঁতার কাটতো। ডুবসাঁতারে কারো সাধ্যি ছিল না তার সঙ্গে পেরে ওঠা। পোকাটা একটা ভ্যাবলা–এই ছিল মনি ভাইজানের ধারণা।
মনি ভাইজানের সামনে পড়ে গেলে সবসময় একদিকে কেটে পড়বার তাল করতো পানু। মনি ভাইজান ধরে ফেলে বলতো, এ্যাই, টিনজার মানে কি?
পানু আমতা আমতা করে বলতো, টাঁজা।
টিনচার মানে কি?
টাচা।
প্যাঁপোঁ মানে কি?
পোঁপা–
তখন মনি ভাইজান বলতো, প্যান্ট খোল হারামজাদা, প্যান্ট খোল!
পানু বোতাম খুলে প্যান্টটা ছেড়ে দিতো।
এইবার গুণে গুণে তেরোবার কান ধরে উঠ-বস কর। দম ছাড়বি না, খবরদার!
পানু তাই করতো।
এইরকম অদ্ভুত অদ্ভুত সবখেয়াল ছিল মনি ভাইজানের। ঘোষালদের ছেলে গনু একবার কুল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে। সেই থেকে গনুকে দেখলেই মনি ভাইজান, বলতো, এই, পা টেপ, মুও ছাতুছানা করে দেব তোর।
গনু বসে বসে পা টিপে দিত মনি ভাইজানের। আর মনি ভাইজান গান ধরতো আয় বাদি আয় বেগম হবি, আমি খোয়াব দেখেছি, আমি পেখম মেলেছি, আমি সজ্জা করেছি—
মনি ভাইজানের সঙ্গে আমি মাঝে মাঝে হাতিপুকুরের পাড়ে যেতাম। মনি ভাইজান বলতো, ঐ কোর্টবাড়িতে যাবার একটা গোপন সুড়ঙ্গ আছে পানির তলায়, সুড়ঙ্গটা বের করতে হবে। ঐ গোলবাড়িটার নিচে কি আছে জানিস পোকা? ওয়ারেন হেস্টিংস-এর গুপ্তধন। বড় হলে তার কথা জানতে পারবি।
মাঝে মাঝে হাতকড়া পরা কয়েদীর পালকে কোমরে দড়ি বেঁধে কোর্টে নেওয়া হতো। মনি ভাইজান তখন রাস্তার ধার থেকে চেঁচিয়ে বলতো, এই যে জাহামাহাই বাহাবাহারা জিহিলিহিপিহি খাবে?