মাকে ঠকানো খুব সহজ ব্যাপার ছিল। কেঁদে পড়লেই হলো। চাল-ডাল, পুরনো কাপড়, আলুটা পেঁয়াজটা বিলানো এসব তো ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। খুব সহজেই মানুষের মুখের কথা বিশ্বাস করে ফেলতো মা। এভাবে প্রায়ই একে-তাকে বাড়িতে আশ্রয় দিত। তারপর দুচারদিন যেতে না যেতেই দেখা গেল এটা-ওটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, যথারীতি নতুন মানুষটিও উধাও।
আমরাও নানারকমে মাকে ঠকাতাম। টিপু ভাইজান ও মনি ভাইজান যোগসাজশ করে প্রায়ই বোকা বানাতো মাকে। অনেক সময় রানিবুবু বুঝতে পেরে সব ফাঁস করে দিত মার কাছে। ঝগড়াফ্যাসাদ কম হয়নি এসব নিয়ে।
এই রকম কতো কি!
শীতকালের সকালে মাঝে মাঝে পুকুরের কোণে জোড়া কুলগাছের তলায় মাদুর পেতে আসন গেড়ে বসে দুলে দুলে রিডিং পড়তো সবাই পাল্লা দিয়ে। আব্বা ডুবে থাকতো ডিকশেনারির ভেতর। কোনো কোনোদিন আবার বসে মটরশুঁটি ছিলতো। ছোলা হয়ে গেলে বলতো, পোকা যাও, তোমার মাকে দিয়ে এসো। আর কিছু ছোলার থাকলে তাও নিয়ে আসবে।
কুলগাছতলায় বসেই দুধ-মুড়ি থিন এ্যারারুট বিস্কুট, এইসব খাওয়া চলতো। তখনো বইপত্তর ছুঁইনি, মাঝে মাঝে কেবল শ্লেটপেন্সিল নিয়ে মাছ আর হিজিবিজি কাগাবগা আঁকি।
আমাদের একপাশে ছিল কলকাতার বাবুদের বিশাল বাগান, নন্দনকানন। বাগান দেখাশোনার জন্যে কুঁড়েঘর তুলে বসবাস করতো সাঁওতালরা। ওদের ডাকতে হতো সর্দার বলে। কাঠবিল্লীর ওপর ছিল ওদের ভারি লোভ, চোখে পড়লে আর রক্ষে নেই, ঘচাং করে তীর মেরে তাকে মাটিতে ফেলবে। মাঝে মাঝে দেখা যেতো তারা দল বেঁধে শিকার থেকে ফিরছে; কাঁধের বাঁশে ঝোলানো বুনো শুয়োর, বনবিড়াল আর কাঠবিল্লী। ওদের কুকুরগুলো ছিল বেজায় রাগী।
আমাদের আশুচাচাও একজন ডাকসাইটে শিকারী ছিলেন। সাঁওতালদের নিয়ে তিনি বছরে দুএকবার শিকারে বেরুতেন। খোলা জিপগাড়ির মাথায় বাঘ শুইয়ে বল্লমধারী সাঁওতালদের নিয়ে তিনি সবগুলো রাস্তায় চক্কর দিতেন। বিশেষ করে এস.ডি.ও আর মনুসেফ সাহেবের কুঠির সামনে পৌঁছানোর পর সাঁওতালদের হৈ হৈ রৈ রৈ আরো বেড়ে যেতো। হরিতলার মোড়ে এলে কিছুক্ষণের জন্যে গাড়ি থামাতেন। তারপর যখন দেখতে না দেখতে মাছির মতো চারপাশে চাক বাঁধাতো মানুষজন, তখন ব্যস্ত হয়ে বলতেন, আঃ কি মুশকিল! ভিড় ছাড়ো, ভিড় ছাড়ো, কি এমন দেখার আছে।
হরিতলায় একটা টিউবওয়েল ছিল। উড়ে নটবরকে প্রায় সারাদিনই দেখা যেতো কল পাম্প করতে। অনেক বাড়িতেই সে সময় টিউবওয়েল ছিল না। তার কাজ ছিল গালের একপাশে পানের ঢিবলে খুঁজে বাঁকে করে বাড়ি বাড়িতে পানি পৌঁছে দেওয়া। সে বেচারা ছিল ভারি ভালো মানুষ। ভালো মানুষ পেয়ে অনেকেই তার পেছনে লেগে থাকতো। আমাদের মনি ভাইজানও তাদের ভেতের একজন। নটবর উড়েকে দেখলেই সে ধক্কা মারিবি ধক্কা মারিবি, তংকা মারিবি কাঁই–বলে চিৎকার করে দৌড়ে একদিকে পালিয়ে যেতো।
সবকিছু ছিল থিতানো। কোথাও কোনো কোলাহল নেই, উপদ্রব নেই; থাকলেও সব বোঝার মতো বয়েস হয়নি তখনও।
দিন দিন একটু একটু করে রাস্তাগুলো চোখের সামনে বড় হয়, আলো-বাতাসের ভেতর নানা রঙের পালক ভেসে বেড়ায়, জানা হয়ে যায় অনেক বাড়ি, তাদের নাম। দত্তবাড়ি, মিত্তিরবাড়ি, ঘোষালবাড়ি, বোসবাড়ি, গোদবুড়ির বাড়ি, করিমন বিবির বাড়ি, এসবই ততদিন চেনা হয়ে গেছে।
মাঝে মাঝে আমরা থলে নিয়ে করিমন বিবির জঙ্গলে ডোবা বাগান গিয়ে হাজির হতাম। তার বাড়ির কাশীর পেয়ারা ঐ অঞ্চলে আমাদের জন্মাবার বহু আগে থেকেই বিখ্যাত ছিল।
হাঁকডাক শুনে একচালা মাটির ঘরের ভেতর থেকে ছেড়া ধুন্ধুড়ি মাকা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে থক খক করে কাশতে কাশতে বেরিয়ে আসতো বুড়ি। বলতো, কি চাইগ কেঁাকারা, এ্যামন হুমদাম নাগিয়েচো ক্যানো!
পেয়ারার কথা শুনে বলতো, আগে দেকেনি পয়সা কতো এনেচো, দাও–
প্রতিবারই বরাদ্দ ছিল সিকি। কাঁপা কাঁপা হাতে পয়সা নিয়ে বলতো, না বাপু, এ্যাতো কোমে কিভাবে দিই বনো দিকিনি! তা কোনো বাড়ির ছেনে তোমরা?
শোনার পর বলতো, এয়েচো যকোন ফেরাবো না। মাকে বোনো, এরপর থেকে এক টাকার কোমে আমি প্যায়রা দিতি পারবো না।
প্রতিবারই এইরকম হতো। বুড়ির কেউ ছিল না। ছানি পড়েছিল চোখে। দুতিন গণ্ডা পেয়ারার নাম করে মনি ভাইজান থলে ভরে পেয়ারা পেড়ে নিত। বুড়ির আন্দাজ ছিল সাঙ্ঘাতিক।
এইরকম আরো একজন ছিল। গিরিবালা। মুখময় তার গুটিবসন্তের দাগ। মাঝে মাঝে আমরা তার ফাইফরমাশ খেটে দিতাম। চলাফেরার তেমন ক্ষমতা ছিল না বুড়ির। আমাদের কাউকে দেখলে মাঝে মাঝে ডেকে বলতো, ও ড্যাবরাচোখে খোকা, আমারে পেঁচোর দোকান থেকে এক পয়সার ইসবগুলের ভুষি এনে দিবি বাবা–
কোদালদেঁতো, খ্যাংরাকাঠি, দেঁতোমাণিক, লগিঠেঙো, পেত্নী চোঁষা, কোমরভাঙা, হুপো—এইভাবে এক একজনকে এক এক নামে ডাকতো বুড়ি।
আমাকে বলতো, হরে ড্যাবরাচোখো, বে করবি আমারে, তোরে আমার ভারি পচন্দ।
গিরিবালাকে আমরা নাম ধরেই ডাকতাম। বলতাম, গিরিবালা, ও গিরিবালা–
ভেতর থেকে বুড়ি বলতো, গিরিবালা মরেচে—
মনি ভাইজান বলতো, শ্মশানে যাবি?
তোর সঙ্গে সমরণে যাবো, নিবি?
বছরে একবার একটা অন্ধ ফকির আসতো, ফেদু। দেশ ফরিদপুর।
তার নাম করে ফেতরার পয়সা ভোলা থাকতো। সে এসে একরাত থেকে যেতো। আমরা তার কাছে নানান রকমের গল্প শুনতাম। সে বলতো ভূত ধরার মন্ত্র জানে। বলতো, বড়শিতে কাঁচা মাছ গেঁথে বাঁশের ছিপ দিয়ে সে নাকি একসময় বাড়ি বাড়ি ভূত ধরেছে।