কি আবার হবে, ঘোড়ার ছাই। নতুন আর দুখানা লঞ্চ চালু করেছে দাদন মিজি,–এম.এল. মীরকাদিম আর এম, এল. ভোগদা, সব মিলে হলে গিয়ে পাঁচটা। গায়ের গন্ধ মোছার জন্যে হয়তো হাতের ময়লা কিছু ঝাড়তে হবে, এর বেশি আর কি!
মিজি এক কাঁড়ি টাকা মাদ্রাসার পেছনে ঢাললো, অথচ কলেজের জন্যে এক কানাকড়িও খসালো না, বেশ কঠিন লোকটাকে বোঝা; কম ধরাধরি হয়েছে! অন্তত দুএক হাজার হলেও তার দেওয়া উচিত ছিল—।
রোগটাই এখনো ধরতে পারেননি দেখছি–নরহরি ডাক্তার হেসে বললে, রহমান ব্যাপারীর নামগন্ধ আছে যেখানে সেখানে দাদন মিজি নেই। এ হচ্ছে নতুন মালকড়িওলাদের নিজেদের ভেতরের খালবিলের নৌকো বাইচ, এ রোগের কোনো দাওয়াই নেই, কি বুঝলেন?
কথায় কথায় বেলা চড়লো অনেকখানি। আবদুল খালেকের যখন ওঠার খেয়াল হলো তখন বাজার ফাঁকা হয়ে গেছে। ফেরার পথে তার মনে হলো এতোটা ভালো নয়, সবকিছুতেই কমবেশি একট হিসেব করে চলা উচিত; মাঝে মাঝে এই যে রেখা তাকে ঝাড়াই করে তা একেবারে অকারণে নয়। সে জানে ঘরে ফিরে এখন তাকে কোন্ ধরনের কথা শুনতে হবে; ছেড়ে কথা বলবে না রেখা।
০৩. পেঁপের আঠার ফোঁটা
এক চামচ গ্লুকোজে পেঁপের আঠার ফোঁটা ফেলে আমাকে খাওয়াতে মা। কোনো কোনোদিন আবার কুমারেশ, কিংবা কালমেঘের বড়ি। বেলপোড়া, বেলের মোরব্বা, কিংবা চুনের পানি, এইসবও চলতো। ঘুম থেকে উঠে সকালে খালি পেটে খেতে হতো।
পোকা, এই ছিল আমার ডাক নাম। কেনারাম বাবুর দেওয়া নাম। তিনি ছিলেন আব্বার বন্ধু। আমরা ডাকতাম কাকা।
কেনারাম বাবুকে নিয়ে একটা ছড়া প্রচলিত ছিল:
কেনারাম কিনে আনে
তুলারাম তুলে রাখে
ফেলারাম ফেলে দেয়
বেচারাম বেচে দেয়
কেনারাম কাকাই জানেন আমার নাম পোকা দিয়েছিলেন কেন। পোকা, পোকা, পোকা আছিস– এই বলে তিনি হাঁকডাক শুরু করে দিতেন।
আমি বেরুলে বলতেন, যা, জুতো পায়ে দিয়ে আয়।
কেনারাম কাকা আমার হাত ধরে হাতিপুকুরের দিকে যেতেন। হাতিপুকুরের গোটা এলাকাটা বিশাল বিশাল রেনট্রিতে ঘেরা ছিল। আর ছিল গুলোর। গাছগুলোর নাম তার মুখ থেকেই শোনা, গাছাগাছড়ার কতো নাম যে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। এখানে সেখানে বড় বড় গাছের ছায়ায় বিছিয়ে থাকতো তেঁতুলের মতো শুকনো ফল; সেগুলো গরু-ছাগলের খুব পছন্দের ছিল।
হাতিপুকরের ঠিক মাঝখানে ঢিপির মতো দ্বীপ। লোহার সাঁকো পেরিয়ে সেখানে যেতে হতো। ঢিপির চূড়ায় গোল চবুতারার নিচে বেদি ছিল, সেখানে আমরা বসতাম।
ওখানে বসে বসে দ্বীপের গায়ের এক একটা গাছের দিকে আঙুল তুলে কেনারাম কাকা বলতেন, ঐ যে গন্ধরাজের মতো যেটা দেখছিস, ওটা হলো গিয়ে তোর হিং গাছ, আর ঐ যে পামের মতো যেটা, ওটা হচ্ছে গিয়ে তোর সাবুদানার গাছ।
ফেরার পথে বলতেন, কি খাবি, পান্তুয়া না রসগোল্লা?
বলতাম, রসমঞ্জরি!
ওই সময় কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে আব্বার সঙ্গে তার অবনিবনা চলছিল, কথাবার্তা বন্ধ ছিল দুজনের। পরে অবশ্য ওসব মিটে যায়।
মাঝে মাঝে ইরানি জিপসিদের তাবু পড়তো হাতিপুকুরের পাড়ে। কুঁচিওলা ঘাঘরা পরা লম্বা লম্বা বেণী ঝোলানো মেয়েরা মাথায় ফুটতোলা রুমাল বেঁধে কামসুতোর দড়ি পাকাতো। ছুরি, কাঁচি, নানা রঙের পাথর আরমার চুলের গুছি, এইসব নিয়ে তারা ঝঝ দুপুরে বাড়ি-বাড়িতে ঘুরতো।
মনে আছে, একদিন ভরদুপুরে মাথায় রুমাল জড়ানো এক জিপসি মেয়ে কিভাবে আমাদের ভয় দেখিয়েছিল। জামার ভেতর রঙিন পুঁতির মালা বের করে ফিসফিসিয়ে মেয়েলোকটি মাকে বললে, বাহোৎ কিমতি, বাহোৎ বাহোৎ কিমতি, সস্তেমে দে দেতা, লেলো, লেলো–
মার কোনো উৎসাহ না দেখে সে আবার বললে, কিসিকোত বোলনা মাৎ, সেরেফ দাশ রুপেয়া, লেও–
মার দরোজা বন্ধ করার উদ্যোগ দেখে সে ফস করে কোমরে গোঁজা ছুরি বের করলে। ভয়ে তো আমাদের হাতে-পায়ে খিল ধরা অবস্থা। সেই পুঁতির মালা শেষ পর্যন্ত মাকে নিতে হয়েছিল।
আর একবার একটা কাণ্ড ঘটেছিল। হঠাৎ এক দুপুরে এসে হাজির চিমটেওলা এক সাধু, সারা গায়ে ছাইমাখা, মাথায় গিটবাধা খোঁপা। বললে, মানস সরোবর থেকে আসলাম
মা একটা আধুলি দিলে আমার হাতে, বললে যা দিয়ে আয়—
সাধু বললে, আমি ভিক্ষে নিই না।
মা জিজ্ঞেস করলে, তাহলে আপনি কি চান?
তোর ঘরে না একটা সিন্দুক আছে কাঠের?
মা আমতা আমতা করে বললে, আছে, আমরা তাতে লেপতোষক রাখি—
জানি জানি, সবই জানি, না জানলে আর বলছি কিভাবে! তুই একটা বোকা সাধু হেসে বললে, লেপ-তোষক দিয়ে ওটাকে ভরিয়ে রেখছিস! আমি ইচ্ছে করলে তোর ঐ সিন্দুকটাকে টাকায় ভরে দিতে পারি।
সব শুনে মা হাঁ হয়ে গিয়েছিল।
শুধু একটা ফুঁ! যে টাকায় ফুঁ দেব সেটা এক লক্ষ গুণ বেড়ে যাবে–
কুড়িয়ে-বাড়িয়ে গুচ্ছে নোট এনে সামনে ধরে মা। ফুঁ দেবার পর সাধু বললে, গোপন রাখার কথাটা, বলবি না কাউকে, রাত ঠিক দুটোর সময় টাকায় আর যাবে সিন্দুক।
মেঝের ওপর টাকাগুলোকে ছড়িয়ে দিয়ে দুহাতে ঘেঁটে দিলে সাধু।
কিন্তু সে রকম কিছু ঘটেনি।
রাতে বারবার উঠে মার সিন্দুক খোলাখুলি দেখে আব্বা সম্ভবত কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছিল। বললে, আসলটা গুণে দ্যাখো–
সে হিসেব মার নিজেরও জানা ছিল না। কৌটো-কাটা, বিছানার তলা, বাক্স, শাড়ির ভাঁজ, এইসব হাতড়ে যেখানে যা পেয়েছিল, তাই হাজির করেছিল সাধুর সামনে। তবে বহু টাকাই যে হাতসাফাই হয়ে থােয়া গিয়েছিল তা ধরতে কোনো অসুবিধে হয়নি।