আমি মানে তুমি। তুমি শুধু একটা কাজই পার, আমাকে ছোট করতে। এতেই তোমার আনন্দ।
আমার সবকিছুতেই আনন্দ, এখন বাজারের থলে দাও, পরে আর কিছু পাওয়া যাবে না–
যেতে হবে না তোমাকে বাজারে!
থলে দাও, থলে দাও–
বললাম তো, দরকার নেই তোমার যাবার, আজ আমি কিছুই করতে পারবো না।
তুমি না পারলে আমি পারবো। দুপুরের পরে শুধু ডিগ্রীর একটা ক্লাস নিলেই চলবে। কেমন পটেটো চটকই আজ দেখো—
চায়ের কাপ নিয়ে উঠোন পেরোয় রেখা, তারপর রান্নাঘর থেকে বলে, বাপও হয়েছ বলিহারি, উঠে থেকে ছেলেটার একবার খোঁজ নিলে না।
উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আবদুল খালেক বললে, কেন ওটার আবার কি হলো?
একগ্লাস দুধ কোনোমতে ওষুধগেলা করে তারপর উধাও–
খুব বেশিদূর যেতে হলো না আবদুল খালেককে। গালে আঙুল পুরে পুকুরে পাকাটির ছিপ ফেলে হাবার মতো অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল টুকু।
আবদুল খালেক বললে, এইসব হচ্ছে—
টুকু বললে, আব্দু, তোমার ছংগে দাবো
আবদুল খালেক তার কপালে চুমু খেয়ে বললে, বাজারে অনেক ভিড়। এখন ঘরে যান। আপনার জন্যে পেয়ারা নিয়ে আসবো
তালে লুলতি আনবে!
লুলতি মানে গুলতি; আবদুল খালেক ছেলের গাল টিপে দিয়ে বললে, আনবো, সব আনব। টুকুবাবু, আপনি এবারে ঘরে যান—
দুটি বেলে, তিনটি ট্যাংরা, গোটা কয়েক পুরু পুরু খলশে বৈচা এলং টাটকিনি পিয়ালি আর পনেরো বিশটার মতো পুঁটি, এই নিয়ে একভাগা মাছ। পছন্দমতো জালি কুমড়াও পেল আবদুল খালেক। বেগুন কিনলো আধসের। তারপর টুকুর পেয়ারা আর গুলতি।
মুদিখানার একটা ছোকরার হাতে থলেটা পাঠিয়ে দিয়ে অন্যান্য দিনের মতো নরহরি ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে বসে আবদুল খালেক। বললে, রাত্রে ঘুমের বড় ব্যাঘাত হয়েছে—
নরহরি ডাক্তার হেঁকে চায়ের কথা বলে সিগ্রেটের প্যাকেট এগিয়ে দেয়। বললে, আমি নিজেও দুরাত ভালোমতো ঘুমুতে পারিনি। গরমটা কি! শালার বসে সুখ নেই, খেয়ে সুখ নেই, শুয়ে সুখ নেই। জল বেড়েছে কি রকম এ-দুদিনে দেখেছেন?
সেই রকমই যেন মনে হলো সকালে, ঘাটের তক্তায় পা রাখলে ডুবে যায়।
নরহরি ডাক্তার বললে, ছেলেকে দিয়ে এই একটু আগে চালতা পাঠিয়ে দিয়েছি আপনাদের বাড়িতে, দুপুরে টক খাবেন। আমার তো দুপুরে টক না হলে চলেই না।
বেশ আছেন আপনি ডাক্তারবাবু!
ঠিকই বলেছেন, বেশ আছি।
দুজন রুগী ঢোকায় নরহরি ডাক্তার ব্যস্ত হয়ে পড়লো তাদের নিয়ে। জহর মাঝি আর বাপের হাতধরা পাঁচ-ছবছরের একটি বাচ্চা। জহর মাঝির বগলে থার্মোমিটার পুরে ছেলেটাকে নাড়াচাড়া করতে থাকে ডাক্তার।
বললে, শরীরে মাংস লাগবে কোত্থেকে, একেবারে ফ্যাকাসে মেরে গেছে, পেট বোঝাই শুধু কেঁচো।
ছেলেটির বাপের দিকে মুখ তুলে নরহরি ডাক্তার জিজ্ঞেস করে, অহনে কই থাকো?
মধ্যপারা।
বগলেই। বহুৎ গরম! তাপডি গিয়া লউক। কি বুঝলা?
অহনে লয়া যাইতে কন তো?
হ, তাতডি ধরলেই ভান কইরা লয়া আইবা।
জহর মাঝির বগল থেকে থার্মোমিটার বের করে নরহরি ডাক্তার বললে, দুই! বরপোলার খবর কি?
জহর জ্বরের ধকল সামলাতে সামলাতে হাঁপধরা গলায় বললে, অহনে ঢাহায় ফল বেচনের কামে লাগছে।
গ্যারেজের কামডি ছারান দিছে ক্যান?
হের আমি কি কমু।
ট্যাকাউকা দেয় তোমারে?
গেল মাসে যেমুন কিছু পাইছিলো—
পায়খানা হয়?
কষা—
জিব্বা দেহি।
জিভ দেখতে দেখতে নরহরি ডাক্তার জিজ্ঞেস করে, কই দোকান দিছে?
হুনতাছি যেমুন হোসেনি দা–
বাধা দিয়ে নরহরি ডাক্তার বললে, উহু, জিব্বা–শেষে বললে, শিশি আনছো?–
আনি নাই।
মিকচার লইবা কিসে?
আপনেরথে দিয়া দ্যান, ফিরায়া দিয়া যামু—
দিছ আর! লগে পয়সা আনছো কতো, সুই নেওন লাগবো তো–
আনছি কিছু। পয়সার লাইগা চিন্তা কইরেন না, আমারে চাঙ্গা কইরা দ্যান। খারইতে পারি না, মাতা ঝিক মাইরা ওডে!
গাঞ্জাউঞ্জা চারান দিছো তো? দিনে তিন দাগ। কাগজের দাগ খায় ফালায়ো না যেমুন। কাউলকা আয়া ফের সুই লয়া যাইবা, দুদরুটি, নো তালিবালি!
রুগী বিদায় দিয়ে নরহরি ডাক্তার সিগ্রেটের প্যাকেট সামনে ধরে বললে, কি ব্যাপার, চুপচাপ কেন, সিগ্রেট জ্বালান, সিগ্রেট জ্বালান!
হাঁ, কিছু যেন বলছিলেন,বেশ আছি, এই তো? তা বেশ আছি—
স্বচক্ষেই তো সব দেখছি!
মুশকিলটা ঠিক এখানেই। আরে সাহেব দেখার আড়ালেও কিছু আছে। গতরাতে কখন ঘরে ফিরেছি তা জানেন? রাত দুটোয়। ডাইনী দিয়ে ঐসব করালে শেষ পর্যন্ত যা হয়! অবস্থা যখন মরমর, আর কোনো আশা নেই, তখন ছোটো শালা ডাক্তারের কাছে, কিছুতেই রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। ইশ, বিয়ের দিন-তারিখ সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল মেয়েটার। ক্রিমিন্যাল এ্যাবরশন এখন একটা ডালভাতের মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে!
এইভাবে বোধহয় অনেক মরে?
মরে আবার না! সিগ্রেটে লম্বা টান মেরে নরহরি ডাক্তার বললে, সিগ্রেট টেনেও আর কোনো সুখ নেই, যে শালার ঘাস খাচ্ছি। শুনেছেন কিছু? রহমান ব্যাপারীর শালার খুনি নাকি পরশু রাতে বাহিরঘাটায় ধরা পড়েছে।
শুনিনি—
আরে সাহেব আপনাদের কলেজের অতবড় ডোনার রহমান ব্যাপারী, আর খবরই রাখেন না! আরে সেই যে হেকমত, মনে নেই, আপনাদের কলেজের ইউকশনে ব্যালট বাক্স যে ছিনতাই করলে সেবার! ব্যাপারটা নার্কি প্রেম সংক্রান্ত।
আপনি দেখছি সব খবরই রাখেন–
কানে আসে, শুনি। হতভাগাটার মেদেনীমণ্ডলের দাদন মিজির বৌয়ের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক ছিল। মিজিই খারাবিটা ঘটিয়েছে।
কি হবে এখন মিজির?