রাজা গো! তুমি কই?
ঘু-ঘু করে ঘুঘু ডাকে। কাটবাদাম গাছের শুকনো লাল পাতার আড়ালে একটা ছাতারে পাখি উঁকি মেরে টু-কি টু-কি করে তাকে দ্যাখে। রেখা বললে, খুব মজা লাগছে না? শুয়োর—
এক একবার এক একটা কথা উঁকি দেয়। কেন যে আমি টুকু সোনাকে রেখে এলাম, এ কেমন মা! ঐ লোকটাকে আমি এখনো বুঝে উঠতে পারলাম না; যতো খারাপই হোক, তবু তো আমি নাড়ি-নক্ষত্র বুঝে ফেলেছিলাম মামীর। আর এই লোকটা, এর কিছুই বুঝি না, পা থেকে মাথা এর হেঁয়ালি, গোলমেলে। পরিপাটি করে খোঁপা বেঁধে দিলে খুশি হতো মামী। তলপেটে তেল মালিশ করে দিলে বড় আরাম পেত। সেদিন সব গোনা মাপ। সবসময় তার তালে তাল দিতে হবে, এই রকমই একটা আবদার ছিল মামীর। এই লোকটি কি যে চায় বোঝা যায় না। না, কোনো কিছুই চায় না এ লোকটা! এমন ভেতরগোজা মানুষ নিয়ে ঘর করা কি কঠিন!
পোকা, পোকামণি!
রেখার ডাকাডাকিতে বুনো গন্ধ শির শির করে, হলুদে সবুজে হু-হু করে গুমরে ওঠে শান্ত আলো। শেষ পর্যন্ত আবদুল খালেককে খুঁজে বের করলে রেখা। একটা তমাল গাছের গায়ে পিঠ রেখে পা লম্বা করে বসেছিল সে।
ঝপ করে বসে পড়ে রেখা।
তুমি এখানে?
আবদুল খালেক তার গলা জড়িয়ে ধরলো।
রেখা বললে, রাজা, তুমি আমাকে ভালোবাসো। রাজা তুমি আমাকে ভালোবাসা দাও, আমি মরে যাবো–
আবদুল খালেক তার চোখে চুমু খেল। তারপর বললে, তুমি খুব সুন্দর, তুমি জীবনভর থেকো, যেদিন মরবো, তোমাকে দেখতে দেখতে যেন মরি—
রেখা কাঁদলো; আর এমনভাবে কাঁদলো যেন তার প্রতিজ্ঞা ছিল আজ সে ঠিক এইখানে, এইভাবে, মাটির ওপর উপুড় হয়ে, শেষবারের মতো করে কাঁদবে। প্রাণভরে নিজেকে নিংড়ে নিংড়ে। তার সে কান্নায় এমন কিছু ছিল, যাতে আবদুল খালেকের এই প্রথমবারের মতো মনে হয়, ওর কোনো অভিযোগ নেই, ও কিছুই চায় না,জীবনে এত শক্ত মার খেয়েছে। সে বললে, আমার মাধুরী, মাধুরানী আমার, কেন এমন করে জীবন দিয়ে ফ্যালো–
রেখা কোনো কথা বললে না। তার ভেতরে দারুণ একটা জিদ, আজ যদি আবদুল খালেক তাকে ধরে মারেও, সে কোনো কথা বলবে না। বলার মতো তার আর কিছুই নেই। যা বলার সব সে বলে দিয়েছে। আর সে বেহায়াপনা করতে পারবে না।
আবদুল খালেক অবলীলাক্রমে তাকে তুলে নেয়। তারপর দপদপ করে হাঁটে। কদমের বনে দামাল বাতাসের এক একটা ঝাপটা অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঝোপের আড়ালে নিয়ে ঘাসের ওপর শুইয়ে দেয় সে রেখাকে। রেখা বললে, ওগো আমার ভয় করে, এখানে না। কেউ যদি দ্যাখে—।
আবদুল খালেক বললে,তোকে আমি ভীষণভাবে চাই, ওরে মাধু আবদুল খালেক তার ভেতরের এক থাবাওলা, লোমশ, দাতাল অচেনা জানোয়ারকে দেখতে পেল, গাছের ছায়ায় ছায়ায়, পাখির সরল শিসে, যে এতদিন অকাতরে ঘুমিয়েছে। সে তাকে আহ্বান করলো।
রেখা বললে, রাজা, আমার পিঠে লাগে—
লাগুক—
আমাকে ভালোবাসো রাজা, আদর করো–
গরগরে চণ্ড ও আত্মবিস্মৃত আবদুল খালেক তার গহিন উন্মত্ততার পাতাল থেকে বললে, আমার মাধুরী, মাধুরানী–
রেখা বললে, রাজা আমি মরে যাবো, আমাকে আদর দাও–
অনেক অনেকক্ষণ পর আবদুল খালেক যখন উঠতে যাবে রেখা তার গলা জড়িয়ে ধরে। বললে, আমাকে ধরো, আমাকে জড়িয়ে ধরে আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকো।
আবদুল খালেক রেখার কানে মুখ নিয়ে বললে, ব্যথা পেয়েছো?
রেখা কান্নার মতো করে বললে, বুঝতে পারো নি?
ঠিক ইচ্ছে করে নয়, কি ভাবে যেন হয়ে গেল—
আমি ভয় পেয়েছিলাম!
এ কথায় আবদুল খালেকের ভিত পর্যন্ত কেঁপে যায়। সে জানে তার দুটো হাত নির্বোধের মতো রেখার গলার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল, যে-কোনো মুহূর্তে ভীষণ একটা কিছু ঘটে যেতে পারতো,
যে-কোনো মুহূর্তে; অশ্য তখন রেখার চোখ বন্ধ ছিল।
সে বললে, হয়তো অনেকদিন পর, তাই! আর কখনো হবে না–
রেখা বললে, আমি কিছু মনে করি নি। তোমার ভালো লেগেছে?
খুব!
তুমি সুখী হয়েছে?
আবদুল খালেক সে কথা প্রমাণ করার জন্যে রেখাকে বুকের ভেতরে নিয়ে অস্থির করে দিল চুমোয় চুমোয়।
একটা গলা ডোবানো হিজলের আড়াল নিয়ে পানিতে নামে রেখা। আবদুল খালেক বললে, ভয় নেই, ভালো করে নামো, এখানে দেখার কেউ নেই।
রেখার পরনে পেটিকোট আর ব্লাউজ। শাড়ি ডাঙায় রেখে সে পানিতে নেমেছে। আবদুল খালেকও নামে সেইভাবে, গাছের ডালে তার সার্ট-প্যান্ট।
রেখা আবদুল খালেকের পিঠ ধরে অনেকক্ষণ সাঁতার কাটে।
আবদুল খালেক বললে, কিছুদূর যাবে?
রেখা বললে, দূরে যেতে ভয় করে—
ধরে থাকো–এই বলে খালের বেশ কিছুদূর পর্যন্ত যায় আবদুল খালেক। বেশ কিছুদূরে ধানখেতের মাঝখানে একটা নৌকা। আবদুল খালেক আর এগোয় না। ফিরে আসে।
প্রায় ঘন্টা দেড়েক ধরে তারা এইভাবে পানি ছিটোয় আর মাতামাতি করে। রেখা বললে, চলো, খুব হয়েছে, জ্বর না আসে আবার —
গেঞ্জি দিয়ে মাথা মুছে রেখাকে সেটা দেয় আবদুল খালেক। রেখা বললে, কতো অসুবিধে, এতো জানলে কাপড়-চোপড় নিয়ে আসতাম। এখন খালি গায়ে শুধু শাড়ি জড়িয়ে থাকতে হবে। কেমন দেখাবে? লোকে দেখলে কি বলবে?
আবদুল খালেক বলে, ছইয়ের ভেতরে বসে থাকবে, আমি ছাড়া আর দেখছে কে?
মরণ মাঝি কি ভাববে বলো তো?
আবদুল খালেক রেখার গাল টিপে দিয়ে বললে, ভাববে মেয়েলোকটা একটা বখাটে ছোঁড়ার সঙ্গে যাচ্ছেতাই ইয়ে করে বেড়াচ্ছে–
রান্না শেষ হয়ে গিয়েছিল মরণ ঢালির। কলাপাতায় ঢেলে তিনজনে একটা গাছের ছায়ায় বসে বসে খেল। ইলিশ মাছ আর ভাত। রেখার খুব খিদে পেয়েছিল। সে পেটভরে খেল। বললে, মাঝির রান্নার হাত খুব সুন্দর। আমাকে রান্না শেখাবে?