ধরো ময়না—
একটা নদীর নাম—
তিতাস—
একটা মানুষের নাম—
টুকু–
আবদুল খালেক বললে, ভেবে দ্যাখো আগাগোড়া ব্যাপারটা। তুমি রোজ খাচ্ছো চুনোপুঁটি, কিন্তু মাছ বলতে প্রথম তোমার মনে এলো রুই মাছের কথা। প্রতি মুহূর্তেই তুমি ডাহুকের হাক শুনতে পাচ্ছো, মাছরাঙা, বক, ফিঙেকে উড়তে দেখছো, তবু ময়নার নাম প্রথমেই মনে এলো। ময়না বোধহয় বাঁধাবুলি আওড়ায়, হয়তো সেই জন্যেই। আমরা যাচ্ছি পদ্মার দিকে এই একটু আগেও তুমি শুনলে, অথচ নদীর নাম বললে তিতাস। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ব্যাপারটা তো এই! অভ্যস্তার বাইরে তুমি যেতে পারলে না। একটা মানুষের কথা বললে টুকু। সামনে আমি ছিলাম, এমন কি মরণ ঢালির নামও তুমি করতে পারতে। তার মানে টুকুর কথা তুমি সবসময় ভাবছো, অথচ সঙ্গে আনো নি। সব ব্যাপারটাই হচ্ছে গরমিলের। এই গরমিলের ভেতরে হয়তো হিসেব নেই, কিন্তু সত্যি আছে। তোমার ওই ঘর-সংসারের কথাই যদি ওঠে, সেখানে দেখো ঐ গরমিলের ভেতরে সত্যিটাকে কেউ পোছেই না, তার বেলায় শুধু গা বাচিয়ে চলা, টানা-হাচড়া হয় কেবল হিসেবটাকে নিয়ে–
রেখা বললে, আমি তোমার ছাত্রী হতে চাই না।
আবদুল খালেক বললে, ভালো হচ্ছে না রেখা, খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু–
ইস, তোমাকে আমি ভয় পাই? কি করবে কি?
কি করবো? অন্তত ঐ মাঝির সামনে তোমাকে জড়িয়ে ধরে চাকুম-চুকুম করে দুচারগণ্ডা চুমু খেয়ে ফেলতে পারি—
বাহাদুর!
পারি না বলছো?
তুমি সব পারো—
তাহলে দেখ নিজের বৌকেও চুমু খেতে পারছি না, তাকে অপদস্থ করা হচ্ছে।
না গো, তোমার সঙ্গে আমি ঘর করতে পারবো না–রেখা আবদুল খালেকের ঊরুতে চিমটি কেটে বললে, তুমি মানুষটা বড় ঘোরালো, জান বেরিয়ে যায়—
আবদুল খালেক বললে, তাহলে ছেড়ে দিচ্ছো?
যাও দিলাম—
আবদুল খালেক গলা বাড়িয়ে বললে, ও মাঝি, এটা কোন্ গ্রাম?
মালনি মিঠুসার—।
এখানে নৌকো ভেড়াও–রেখার দিকে তাকিয়ে আবদুল খালেক চাপা গলায় বললে, আমি এখানেই নেমে যাবো—
মরণ ঢালি বেছে বেছে একটা আড়াল খুঁজে বের করে।
গলাপানিতে দাঁড়ানো হিজল গাছের কোল ঘেঁষে ঘন বৌনার জঙ্গল। এর মাঝ দিয়ে রাস্তা করে কচু আর নলবনের ওপর মড়মড়িয়ে সে তার সুকাঠের নৌকোটাকে ঠেলে দেয়। নৌকো পাড়ে ভিড়তে না ভিড়তে আধশোয়া কাশবনের ভেতর লাফিয়ে পড়ে আবদুল খালেক দৌড় দিল,
আমি চললাম—
ইচ্ছামতো ঘুইরা লন! পাক-শাক কইরা খায়ালয়া এলা হের পর স্যান মেলা করুম মরণ ঢালি রেখাকে নামিয়ে দিয়ে বললে, জনমনিষ্য নাই, খালপাড় বরাবর ব্যাকই জঙ্গল!
কেমন যেন একটু গা ছমছম করে রেখার। বড় ভয় তার সাপখোপের। পা টিপে টিপে হাঁটে আর ঐদিক-ওদিক দ্যাখে। ওগো, তুমি কই?
কোনো সাড়া পাওয়া যায় না আব্দুল খালেকের। চেঁচামেচি জুড়ে দেয়া একটা কাঠঠোকরা উঠে যায়। যতোই এগোয়, খাড়া মাস্তুলের মতো কদমের ঘন বন দেখতে পায়। বর্শার ফলার মতো পাতার ফাঁক দিয়ে যেটুকু রোদ এসে পড়ছে তা কিছুটা ছিন্নভিন্ন, ফালাফালা, তার কোনো তেজ নেই। রেখা আবার ডাকলো, ওগো তুমি কই?
তা লুকোচুরি খেলার জায়গা বটে। রেখার মনে হয়, পাজিটা হয়তো ঘাড় গুজে চুপিসারে পেচ্ছাব করতে বসেছে কোথাও।
একজোড়া ইষ্টিকুটুম পাখি তার সাড়া পেয়ে ঝটপট করে একটু দূরে জামগাছে গিয়ে বসে। রেখা বললে, ও কুটুম পাখি, তাকে দেখেছো?
রেখার চোখ গেল একটা নধর গুইসাপের ওপর। ঝোপে ঢুকতে গিয়েও সে থেমে গেছে, ঘাড় ঘুরিয়ে খুব মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখছে।
দেখাচ্ছি মজা এই বলে একটা মাটির ঢেলা ছুঁড়লো সে, নচ্ছার হ্যাংলা!
আসশ্যাওড়া পাতা ছিঁড়ে নিয়ে তার গন্ধ শুকতে শুকতে রেখার মনে হলো, কোনোদিন সে এইভাবে বাইরে আসে নি! নাগালে পেলেই এক একটা পাতা ছেড়ে আর নাকের কাছে ধরে। বুনো ঝঝে মাথা ঝিমঝিম করে। এই গাছগুলোর প্রাণ আছে। এক একটা হেঁড়া পাতার গায়ে হালকা নিশ্বাসের গন্ধ, আমাকে মারলে–এই রকম। রেখা বললে, মারবো, আরও মারবো। পারলে বাধা দাও। যতো খুশি মারবো, ইচ্ছেমতো মারবো। একটা একটা করে সব পাতা ছিঁড়ে ফেলবো, সব গাছ উপড়ে ফেলবো। আমার নাম রেখা, আমি তোমাদের রানী—
রেখার নিজেকে খুব হালকা মনে হলো। গা জড়াজড়ি করা কদমের বন তাকে পথ ছেড়ে দিচ্ছে, এক একটি লতা খুশিতে উপচে উঠে দোল খেয়ে বলছে, তাহলে তুমি এসেছো, এতোদিন পরে মনে পড়লো আমাদের–
রেখা মনে মনে বললে, আসতে পারি নি, কাজে বড় ব্যস্ত থাকি, তা না হলে বেশ লাগে, এই যেমন এখন—
একটা ধেড়ে কোলাব্যাঙ তিন লাফে অদৃশ্য হয় আর মার্টির হুঁকোবুড়োর মতো মাথা নাড়তে থাকে কালকচুর পাতা। ব্যাঙটা একটা বেহায়া জোকার, রেখা ভাবলো, লাফ মারার ভেতরেও পষ্ট ইয়ার্কি, হাত-ছুঁড়ে কেমন যেন তে-ফেরেঙা হয়ে লাফাচ্ছিল, ব্যাটার খুব চর্বি হয়েছে, খুব আনন্দে আছে—
বনময় সিল্কের বাতসে; পাটভাঙা, নরোম, আলুথালু। রেখার মনে পড়লো, ইস্কুলে থাকতে সেই শেষের দিকে, তারা একবার দল বেঁধে পিকনিকে গিয়েছিল শ্রীমঙ্গলে। একা একা সে শালবনের ভেতর ঘুরেছিল। কেন যে তার এমন মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল সেদিন! ভীষণ কান্না পেয়েছিল। রাখ, তোকে কিভাবে জব্দ করি দ্যাখ—সমস্ত নিস্তব্ধতা যেন দাঁত কিড়মিড় করে তার দিকে তেড়ে এসেছিল। ঘরে ফিরে মার খেয়েছিল সে মামির কাছে। এমন এমন গাল শুনতে হয়েছিল তাকে যে ঘেন্না ধরে গিয়েছিল নিজের ওপর। মনে হচ্ছিল, এমন দাঁতে দাঁতে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না, গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়ে মরবে।মামার আড়ালে সর্বক্ষণ পিশপিশ করতো মামি। উঠতে-বসতে খোটা দিতো। চুল আচড়াতে দেখলে হাত থেকে কাঁকুই কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতো। বলতো, সবসময় শুধু সাজন–গোজন, কুটোটি নেড়ে দুখানা করবে না, গাগতরে যে ঘুণ ধরবে। দুটো চেহারা ছিল মামীর। মামার সামনে এক রকম, আড়ালে ঠিক তার উল্টোটি, গলার স্বরই বদলে যেত মামীর। একবার অসাবধানে তার হাত লেগে তেলের বোতল উল্টে যাওয়ায় দাঁড়িয়ে লাথি মেরেছিল মামী, মামী মামী-রেখার দুচোখ ছাপিয়ে উঠলো, অনেকদিন পর একটা কষ্ট ভেতরে ভেতরে তাকে ছত্রখান করে দিল, মনে হলো কোনোদিন তার কেউ ছিল না, সে খুব একা, সে কি কোনোদিন কারো আপন হতে পারবে না।