কাচটা ছিল অদ্ভুত। সেটার ভেতর দিয়ে দেখলে রাস্তাঘাট গাছপালা সব থাককাটা রঙধনুর মতো মনে হতো।
ছিল এইসব, এই নিয়ে খেলা।
পুকুরের সেই শানঘাট, কতো সময় যে কেটেছে সেখানে। হাড়িডোমেরা কেঁচড় ভেঙে গুচ্ছের ব্যাঙের ছাত-ঘাটের ওপর ঢেলে রেখে পানিতে নামতে, শানঘাটের গায়ে চরে বেড়ানো গুগলি শামুক তুলে তুলে ভরে ফেলতো কৌটো; গালে বুড়ো আঙুল পুরে কেবল এইসব দেখা, এই ছিল আমার কাজ। তারপর ঘাট ফাঁকা হয়ে গেলে গাল থেকে আঙুল বের করে বলতাম, মাছভাই, মাছভাই, আমি যেন খুব শিগগির লাল মিঠাইওলা হতে পারি। মাছভাই মাছভাই আমি যেন পানুদার মতো মিনজার মানে মাদা, গিনজার মানে গাজা প্লান্ডু মানে পেঁয়াজ, এইসব পটাপট বলতে পারি!
০২. চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে
রেখা চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বললে, কাল অত রাত অব্দি বসে বসে কি করলে?
আবদুল খালেক বললে, এই একটু বইপত্তর নাড়াচাড়া আর কি!
বইপত্তর? আমি তো দেখলাম কি কোথায় সব লিখছিলে তুমি!
ওই আর কি–
বলতে অসুবিধে আছে?
অসুবিধে আবার কিসের—আবদুল খালেক লজ্জিত হয়ে বললে, বলার মতো তেমন কিছু নয়, এই হিজিবিজি!
ঠিক বুঝলাম না, হঠাৎ আবার তোমার ডায়েরি লেখার শখ চাপলো কেন!
আবদুল খালেক শিস টেনে কাপে চুমুক দিয়ে বললে, ধরো কোনো কারণ নেই–
শুধু শুধু সময় নষ্ট–রেখা টেবিল গোছাতে গোছাতে ঠাণ্ডা সাদামাঠা গলায় বললে, কি লাভ এসবে!
কি জানে, তুমিই বোঝ—
রেখা, আজকাল সবকিছুতে তুমি লাভ খোজো। এমন তো আর কোনো কথা নেই যে সবকিছুতেই লাভের গন্ধ থাকতে হবে–
নেই, আবার আছে! আগের চেয়ে অনেক রূঢ় শোনায় রেখার গলা। বললে, তুমি ছাড়া আর সকলেই লাভ-লোকসানে হিসেব কষে চলে। সবাইকে চলতে হয়। চলা উচিত—
আবদুল খালেক আহত হয়ে বললে, আমাদের কি চলছে না?
একে চলা বলে না, কোনোরকমে জোড়াতালি মেরে আমি চালিয়ে নিচ্ছি, তোমার মুখের দিকে চেয়ে, জোর করে। তুমি সংসার পাতোনি, অথচ তার জালে জড়িয়ে পড়েছ, তোমার অবস্থাটা এই। সব বুঝি। তুমি না পারছো গিলতে, না পারছো ওগরাতে। দিনের পর দিন তো দেখছিই, কোনো ব্যাপারেই তোমার কোনো চাড় নেই!
আবদুল খালেক বললে, তুমি কি আমাকে আমার ক্ষমতার বাইরে চলতে বলো, না কেউ তা পারে?
না পারারই-বা আছেটা কি? তোমার জায়গায় আমি হলে তাই করে দেখাতাম। চিরকাল ঠুঁটো হয়ে হাত-পা জড়ো করে বসে থাকবে, আর ক্ষমতার দোহাই পাড়বে, এটাই বা কেমন কথা! তোমার ভেতরে ছিটেফোঁটা উদ্যোগও যদি থাকতো একটু ভেবে নিয়ে রেখা বললে, কেন, তোমাদের টি. মোল্লা কতোদিন থাকলো কলেজে? মাত্র আট মাস! মাস্টারির মুখে ঝাড়ু মেরে ব্যাঙ্কের চাকরিতে ঢুকে তার কি বেশি টাকা রোজগার হচ্ছে না?
আবদুল খালেক বললে, ও চাকরি টি. মোল্লার আরো আগেই পাবার কথা। নিছক বসে থাকবে না বলে ঐ সময়টুকুর জন্যে মাস্টারিতে ঢুকেছিল। ও তো নিজেই বলতো। সকলের সব সোর্স থাকে? টি. মোল্লার আত্মীয়স্বজন কারা তা দেখবে না?
তোমার মতো মানুষদের চিরকাল এইভাবেই নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতে হয়, ঘেন্না লাগে আমার–
আবদুল খালেক হেসে ফেললে। কেন হাসল, নিজেই তা জানে না।
বললে, তুমি যাই বলো, আমরা কিন্তু বেশ আছি, বেশ আছি। সস্তায় খাঁটি দুধ, সস্তায় ছানা, জ্যান্ত মাছ, খারাপটা তুমি দেখলে কোথায়। শহরে থেকে দেড়-দুহাজার টাকা কামিয়েও এভাবে চলা যেতো না, বাড়িভাড়া আর গাড়িভাড়াতেই সব উবে যেতো। এখানে তোমার না লাগছে বাড়িভাড়া না গাড়িভাড়া, সিনেমা-থিয়েটার দেখে, দেন-দরবার করে যে বাজে পয়সা ওড়াবে, তারও কোনো পথ নেই। আমি তো বলি আমরা অনেক ভালো আছি।
রেখা কিছু একটা ভাবলো, তারপর বললে, টি. মোল্লার স্বভাবটাই ছিল দাপুটে, তোমার মতো আধমরা নয়–
রাখো তোমার দাপুটে স্বভাব। স্বর্গে বাস করেই মানুষ স্বর্গের জন্যে কাঁদে, নরকে বাস করে অস্থির থাকে নরকের ভয়ে, চকিতে মনে হলো আবদুল খালেকের; মুখে বললে, জি.এম. মামাশ্বশুর থাকলে অমন দাপট আমারও দেখতে–
কেন কাস্টমস-এ তো তোমার আত্মীয়স্বজন খুব একটা কম নেই, তারা কেউ ভুলেও কখনো পোঁছে?
আবদুল খালেক বললে, সবাই সব পারে না—
এটা কি কোনো জীবন! কান্নায় ভেঙে এলো রেখার গলা। বললে, ইচ্ছে করে গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়ি। এমন একটা জায়গা নেই, যেখানে যাই। এমন একটা মানুষ নেই, যার সঙ্গে দুটো কথা বলি। জঙ্গলের ভেতরে দিনের পর দিন তুমি আমাকে পচিয়ে মারছো, এইভাবে আমাকে দিচ্ছ!
আবদুল খালেক বললে, এতো দূর থেকে কথা বলো কেন, তুমি কিন্তু তোমার মনের শান্তি নিজেই নষ্ট করছে এভাবে। তোমার সঙ্গে আমার কিসের শত্রুতা? শাস্তির কথা ওঠে কেন? আমি লোকটা এতোই খারাপ, এতোই চণ্ডাল!
পরের ঘরে মানুষ জানো বলেই তুমি ভাবো আমি তোমার জ্যান্ত মাছ আর খাটি দুধছানার কাঙাল। খেয়ে-পরেই মানুষ হয়েছি, পেটে পাথর বেঁধে থাকতে হয়নি কখনো–
নিজের জ্বালাতন তুমি নিজেই ঘটাচ্ছ, ইচ্ছে কের গায়ে পড়ে—
আমি জানি কেন তোমার এতো তাচ্ছিল্য, ভালো করেই বুঝি!
আবদুল খালেকের ঘন ঘন ভাবান্তর হয়। এক একবার মনে হয় ভেতরে ভেতরে ধারালো জেদ তাকে মরিয়া করে তুলছে। সে বললে, অতো বুঝ না, অত বুঝতে নেই। তোমার চেয়ে অনেক বিষয়েই আমি কম বুঝি। কম বুঝি বলেই তোমার মতো এমন উটকো ঝক্কিও আমাকে পোহাতে হয় না। আমি যতটুকু, ঠিক ততটুকুই। নিজেকে এর বেশি মনে করতে গেলেই গোলমাল বাধে, বুঝলে!